বিষয়টি হালকাভাবে দেখা যাবে না
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ মে ২০২৩, ১২:১০:৩৭ অপরাহ্ন
গতকাল একটি স্থানীয় দৈনিকে ‘বজ্রপাতে ৭ জেলায় প্রাণ গেলো ১৪ জনের’ শিরোনামে একটি মর্মান্তিক সংবাদ প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়েছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে বজ্রপাতে নারী ও শিশুসহ ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত মঙ্গলবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত সুনামগঞ্জ, নরসিংদী, পাবনা, ব্রাহ্মণবায়িা, কুড়িগ্রাম, চাঁদপুর ও শরিয়তপুরের পৃথক পৃথক স্থানে এসব বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে নরসিংদীতেই মারা যান ৫ জন। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে আহত হয়েছেন আরো অন্তত: ১৬ জন।
দেখা যাচ্ছে, ক্ষেতে খামারে কাজ করার সময় কিংবা মাছ ধরার সময় অথবা নদী দিয়ে যাতায়াতের সময় বজ্রপাতে প্রাণহানির ঘটনা বেশী ঘটছে। বলা যায়, উন্মুক্ত স্থানে বজ্রপাতে হতাহতের ঘটনা বেশী ঘটছে। বজ্রপাতে যে শুধু মানুষই হতাহত হচ্ছে, এমন নয়, গত মঙ্গলবার দিরাইয়ে বজ্রপাতে ২টি গাভী ও একটি ষাড় গরুও মারা গেছে। খাওয়ার জন্য গরুগুলোকে হাওরে ছেড়ে এলে ঘন্টা খানেক বাদে হালকা বৃষ্টির সঙ্গে বজ্রপাত হয়। এতে প্রাণ হারায় গরুগুলো।
এ অবস্থায় বজ্রপাতের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বেশ কয়েকটি অঞ্চলকে শনাক্ত করেছেন আবহাওয়াবিদরা। বাংলাদেশে এপ্রিল থেকে জুনের প্রথম ভাগকে বজ্রপাতের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সময় হিসেবে চিহ্নিত করেছেন আবহাওয়াবিদ এ কে এম নাজমুল। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এ সময় বাংলাদেশের আবহাওয়া সবচেয়ে বেশী উত্তপ্ত থাকে। অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে অনেক জলীয় বাষ্প তৈরী হয়। এ জলীয় বাষ্পই বজ্রপাতের প্রধান শক্তি হিসেবে কাজ করে। জলীয় বাষ্প যতো বেশী হবে, ততো বেশী বজ্র মেঘের সৃষ্টি হয় এবং ঘন ঘন বজ্রপাত দেখা দেয়।
অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশে এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের ওপর গবেষণা চালিয়েছে। তারা বলছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ৮৪ লাখ বজ্রপাত হয়, যার ৭০ শতাংশই হয় এপ্রিল থেকে জুন মাসে।
আবহাওয়াবিদদের পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশের উত্তর, উত্তরপূর্ব এবং উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে সবচেয়ে বেশী বজ্রপাত প্রবণ। বজ্রপাতে হতাহতের ঘটনা বেশী ঘটে হাওর অঞ্চলে। কেননা এসব অঞ্চলে জলীয় বাষ্প বেশী থাকে। সেই হিসাবে সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, সিলেট এবং সেই সাথে টাঙ্গাইল, জামালপুর, ময়মনসিংহকে বজ্রপাতের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদ নাজমুল। তবে কোন অঞ্চলকেই বজ্রপাতের ঝুঁকির বাইরে বলা যাবে না বলে তিনি জানিয়েছেন। গবেষকদের মতে, তাপমাত্রা এক ডিগ্রি বাড়লে বজ্রপাতের আশংকা ১০ থেকে ১২ শতাংশ বেড়ে যায়। আবহাওয়া অধিদপপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর বজ্রপাতে ১৫০ থেকে ২০০ মানুষ মারা যায়। সেই সঙ্গে অনেক গবাদি পশুও মারা যায়। মৃত্যুর সংখ্যা বিচার করে বাংলাদেশ সরকার ২০১৬ সালে বজ্রপাতকে জাতীয় দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করে।
বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো দুর্যোগের ক্ষেত্রে কিছু প্রস্তুতি নেবার সুযোগ থাকলেও বজ্রপাতের বিষয়টি অনেকটা ভূমিকম্পের মতো আকস্মিক। কিন্তু আবহাওয়াবিদরা, রাডার ইমেজে মেঘের অবস্থান অনেক উপরের দিকে দেখলে এবং সেই স্থানে বায়ুমন্ডলে অস্থিতিশীল অবস্থা থাকলে ২ নম্বর সতর্কতা সংকেত দিয়ে থাকেন। এমন অবস্থায় আকাশে কালো মেঘ জমলে ও বিদ্যুৎ চমকাতে দেখলে সবাইকে সাথে সাথে খোলা বা উন্মুক্ত স্থান ছেড়ে দ্রুত নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন তাঁরা।
যেহেতু বজ্রপাত অনেকটা ভূমিকম্পের মতোই প্রায় আনপ্রেডিক্টেবল অর্থাৎ পূর্বাভাসের প্রায় অযোগ্য, তাই এ বিষয়ে মৌসুম, উন্মুক্ত স্থান ও আবহাওয়ার গতি প্রকৃতি বিবেচনায় রেখে বজ্রপাতপ্রবণ এলাকার লোকজনকে বাইরে যাতায়াত ও চলাফেরা করতে হবে। সকল স্থানে নিরোধক দন্ড বা ডিভাইস স্থাপন সম্ভবও নয়। তবে আবহাওয়া অধিদপ্তরকে আবহাওয়া পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সংশ্লিষ্ট এলাকার লোকজনকে আগে ভাগেই সতর্ক করতে পারেন। এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, বজ্রপাত প্রবণ অঞ্চল বা এলাকার ক্ষেতে খামারে কাজ করা ও নদীতে চলাচলকারী লোকজনকে বজ্রপাত সম্পর্কে পূর্ণমাত্রায় সচেতন হতে হবে। আর এই সচেতনতার কাজটি হবে সরকারী উদ্যোগে। এক্ষেত্রে মিডিয়া পালন করতে পারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। আমরা এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দৃষ্টি ও মনোযোগ আকর্ষণ করছি, কারণ বিষয়টিকে আর হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই, দিন দিন এর ভয়াবহতা শুধু বেড়েই চলেছে।