ক্ষুধার্ত সিংহের কবলে সিংহভাগ মানুষ
প্রকাশিত হয়েছে : ০১ জুন ২০২৩, ১২:৩০:০৭ অপরাহ্ন
জাতিসংঘের চরম দারিদ্র্য ও মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ দূত অলিভিয়ে ডি শ্যুটার বলেছেন, দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশ যে অগ্রগতি করেছে সেটি ভঙ্গুর। সম্প্রতি মিডিয়ার সাথে একান্ত সাক্ষাতকারে তিনি এমন মন্তব্য করেন। ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নীত হবার পর মজুরী বৃদ্ধি এবং সামাজিক খাতে বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে শ্যুটার বলেন, বাংলাদেশের উচিত মজুরী বাড়ানো যেনো বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার সুবিধা পেতে দেশটির জনগোষ্ঠীকে দারিদ্র্যের মধ্যে রাখতে না হয়।
বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাম্প্রতিক এক জরীপে দারিদ্র্য কমে আসার বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের সামনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চরম দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসা অনেক মানুষ এখন দারিদ্র্যসীমার সামান্য উপরে ওঠেছে। এর ফলে হঠাৎ কোন বিপদ এলে সেটা মোকাবেলা করার মতো অবস্থা তাদের নেই। অনেক পরিবার দারিদ্র্যসীমার ঠিক ওপরে উঠে এলেও তাদের টিকে থাকার সামর্থ্য নেই। ধাক্কা সামলানোর মতো কোন সম্পদ তাদের নেই। এই অগ্রগতি ভঙ্গুর। ডি শ্যুটার স্থানীয়ভাবে মজুরী বৃদ্ধি ও সামাজিক সুরক্ষার পেছনে বিনিয়োগের আহবান জানান সরকারের প্রতি।
২০২০ সাল থেকে চরম দারিদ্র্য ও মানবাধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত এবং এর আগে ২০০৮ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত খাদ্য অধিকার বিষয়ে জাতিসংঘের বিশেষ দূত হিসাবে দায়িত্ব পালনকারী বেলজীয় আইনজ্ঞ অলিভিয়ে ডি শ্যুটারের বাংলাদেশের অর্থনীতি সংক্রান্ত উপরোক্ত মূল্যায়ন ও মন্তব্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ব্যতিক্রমধর্মী।
ইতোপূর্বে দেখা গেছে, বিভিন্ন বিদেশী সংস্থা, সরকার ও নেতানেত্রীরা যখনই বাংলাদেশে এসেছেন এবং বাংলাদেশ নিয়ে মন্তব্য করেছেন, তখন তাদেরকে ঢালাওভাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির প্রশংসা করতে দেখা গেছে। এছাড়া বিভিন্ন বিদেশী অর্থনৈতিক সংস্থা ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদেরও একইভাবে ঢালাও মন্তব্য করতে দেখা গেছে। দেখা গেছে, দিন দিন দেশের সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক দুর্ভোগ বৃদ্ধি পেলেও তারা বাংলাদেশের জিডিপি বৃদ্ধি, দারিদ্র্য বিমোচনে অগ্রগতি সম্পর্কে এবং এশীয় এমনকি বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় আর্থিক অগ্রগতি ও জিডিপি’র হার বৃদ্ধি নিয়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছে। আর এদেশের সরকারকে তো দেশকে বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল এবং জিডিপি ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিতে চীন ভারত তো বটে অনেক উন্নত দেশকে ছাড়িয়ে যাওয়ার কথা সাড়ম্বরে ঘোষণাও প্রকাশ করতে দেখা গেছে।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রতিবেশী ভারত ও চীনকে ছাড়িয়ে যাবার কথা গত কয়েক বছর ধরে দাবি করা হচ্ছে সরকার ও বিভিন্ন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকে। কিন্তু জাতিসংঘের এই বিশেষজ্ঞ বিশেষ দূতের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, চীন ১৫/২০ বছর আগে যে অর্থনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করে তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে নিশ্চিত ও টেকসই করেছে, বাংলাদেশ এর ধারে কাছেও নেই। যেমন, চীন স্থানীয়ভাবে মজুরী বৃদ্ধি করলেও বাংলাদেশ সরকারের এদিকে কোন উদ্যোগ নেই। শুধু সরকারী চাকুরীজীবীর মজুরী বৃদ্ধি নিয়ে তাদের মাথা ব্যথা। সাধারণ মানুষের মজুরী ও আয় বাড়ে এমন কোন বড় ও কার্যকর পদক্ষেপ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে দেখা যায়নি তাদের। এভাবে সামাজিক সুরক্ষার বিষয়টি উপেক্ষিত ও অবহেলিত অবস্থায় পড়ে আছে বছরের পর বছর ধরে।
অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হচ্ছে, সরকারী পর্যায়ে সাধারণ সীমিত আয়ের মানুষ ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের আর্থিক উন্নতির লক্ষ্যে বাজেটে তেমন কোন বরাদ্দ রাখা না হলেও পদ্মা নদীতে আরেকটি সেতু অর্থাৎ দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হচ্ছে। সাধারণ মানুষের আর্থিক কষ্ট অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছা সত্বেও তাদেরকে রক্ষার কোন প্রচেষ্টা নেই। এর কারণ সহজেই অনুমেয়। এভাবে দেশের সিংহভাগ মানুষের ভাগ্য দারিদ্র্য নামক ক্ষুধার্ত সিংহের খপ্পরে বা কবলে ছেড়ে দিয়ে কিছু সংখ্যক ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাসীনদের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিবর্গের আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। এই অপকর্ম অব্যাহত। তাই অদূর ভবিষ্যতে দুর্বৃত্তদের এই বৃত্ত ভেঙ্গে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয় দেশের অর্থনীতির, এমন অভিমত ডি শ্যুটারের মতো নির্মোহ ও নিরপেক্ষ অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের।