এ লজ্জার শেষ কোথায়?
প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ জুন ২০২৩, ১২:৩০:৫১ অপরাহ্ন
সম্প্রতি দেশের একটি শীর্ষ জাতীয় দৈনিকে ‘মার্কিন নতুন ভিসা নীতি কি সরকারের কুটনৈতিক ব্যর্থতা নয়’? শিরোনামে একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এবার বাংলাদেশীদের ভিসা প্রদানের নতুন নীতি ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশের ৫২ বছরের কূটনীতির ইতিহাসে নজিরবিহীন এক ঘটনা। শুধু নজিরবিহীন বললেই যথেষ্ট হবে না। কূটনৈতিক ব্যর্থতার উদাহরণ হয়ে থাকবে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ও নতুন ভিসা নীতি। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নীতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে গণতন্ত্র, সুষ্ঠু নির্বাচন, মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বাধাদান এবং মানবাধিকার লংঘন ও সহিংসতায় জড়ালে মার্কিন ভিসা দেয়া হবে না। জড়িত ব্যক্তিরা ছাড়াও তাদের স্বামী, স্ত্রী ও সন্তানদের ভিসা দেওয়া হবে না ভিসা বা ভিসা বাতিল করা হবে। সরকারী দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, বিরোধী রাজনৈতিক দল, বর্তমান ও সাবেক আমলা, বিচার বিভাগ ও আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নতুন ভিসা নীতির আওতাভুক্ত থাকবেন।
লক্ষণীয় যে, কোনো সার্বভৌম দেশের জন্য অন্য কোন দেশের এ ধরণের সিদ্ধান্ত যেমন বিব্রতকর তেমনি লজ্জাজনক। কিছু দিন ধরেই দেশে ছিলো নানা ধরণের গুজব ও গুঞ্জন। বেশ কিছু দিন ধরেই শোনা যাচ্ছিলো যুক্তরাষ্ট্র আবারো নতুন করে নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে। ইতোপূর্বে সাত র্যাব ও পুলিশ কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলো। সেই নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকা অবস্থায় আবারো নিষেধাজ্ঞার চেয়ে বহুগুণ মারাত্মক ভিসা নীতি অর্থাৎ ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বিশে^র এই দোর্দ- প্রতাপশালী দেশটি। এর পরিণতি অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে কী হতে পারে, সেই বিচার বিবেচনায় না গিয়ে বলা যায়, বাংলাদেশের মতো যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশসমূহের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল বাংলাদেশের জন্য এই ভিসা নীতি এক কথায় বিপর্যয়কর।
ক্ষমতাসীন দলের লোকজন এবং সরকারের নেতানেত্রী ও কর্তা ব্যক্তিরা এই ভিসা নীতিকে তুড়ি মেরে ওড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করতে দেখা যাচ্ছে। তাদের বক্তব্য, ভিসা নীতি একটি দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার, এটা নিয়ে বাংলাদেশের মাত্রা ব্যথার কোন কারণ নেই। এই বক্তব্যের প্রথম কথাটি ঠিক হলেও শেষোক্তটি যে ডাহা মিথ্যা ও আত্মতুষ্টিমূলক এতে কারো সন্দেহ নেই। এই ভিসা নীতি যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মাঝে শুধু মাথা ব্যথা নয়, মাথায় ম্যালিগন্যান্ট টিউমার হয়ে দেখা দিয়েছে। এতে সৃষ্টি হয়েছে বহু কর্তা ব্যক্তির মাথার খারাপ হওয়ার মতো কারণ। কারণ, বাংলাদেশের উপরের লেভেল তো বটে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অগণিত লোকজনের ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনের সাথে আষ্টে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্র। হয় তাদের গ্রীণ কার্ড ও নাগরিকত্ব আছে, না হয় তাদের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করছে সেই দেশে। এ ছাড়া কয়েক লাখ মানুষের ইমিগ্রান্ট ভিসার আবেদন করা আছে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার জন্য। এর সাথে আরো কোটি লোক নানাভাবে আর্থিক দিক দিয়ে উপকৃত হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীরা রেমিট্যান্স প্রেরণের দিক দিয়ে শীর্ষ স্থানে রয়েছেন। এই রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি। আর বাংলাদেশের প্রধান রফতানী পণ্য তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড়ো বাজার হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়ো দাতা দেশও বটে। এসব ফিরিস্তি দিতে গেলে স্থান সংকুলান হবে না এখানে।
বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যে কোন নেতিবাচক সিদ্ধান্ত, পদক্ষেপ এমনকি চিন্তাভাবনাও বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের জন্য মহা উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তার বিষয়। এ নিয়ে ক্ষমতাসীন মহলের কোন যুক্তি ও কৈফিয়ত যে ভিত্তিহীন ও অযৌক্তিক, এটা দেশের যে কোন সাধারণ মানুষের পক্ষে অনুধাবন করা মোটেই কঠিন নয়। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র এ পর্যন্ত বিশে^র যে সব দেশের ওপর এ ধরণের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে কিংবা নিষেধাজ্ঞামূলক পদক্ষেপ নিয়েছে সেগুলো হয় স্বৈরতান্ত্রিক পিছিয়ে পড়া দেশ, না হয় আফ্রিকার নৈরাজ্যপূর্ণ কোন দেশ। কিন্তু দীর্ঘকালের উজ্জ্বল গণতন্ত্রের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের দেশ এবং গণতন্ত্রের জন্য লক্ষ লক্ষ জীবন উৎসর্গকারী দেশ বাংলাদেশকে কোনভাবেই ঐসব দেশের কাতারে ফেলা যাবে না রাজনৈতিক বিচার বিবেচনায়। কিন্তু এসব অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক দেশের মতোই নিষেধাজ্ঞার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে হয়েছে গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের দেশ বাংলাদেশকে। এর চেয়ে বড়ো অপমান ও লজ্জাজনক ঘটনা বিগত কয়েক যুগে কখনো ঘটতে দেখা যায়নি বাংলাদেশে। এমন কূটনৈতিক ব্যর্থতায় কখনো হোঁচট খেতে দেখা যায়নি এদেশকে। আর এ জন্য যে এদেশের ক্ষমতাসীন মহল দায়ী। সবার অভিযোগের আঙ্গুল সরকার ও সরকারী দলের প্রতি। তাদের প্রায় দেড় দশকের অপকর্ম, দুর্নীতি, খুন-গুম ও অগণতান্ত্রিক আচরণ এবং দেশের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে ফেলার বিষয়টি এ জন্য মূলত দায়ী, এমন অভিমত সচেতন মহলের। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয়, এ ধরণের নিষেধাজ্ঞা ও ভিসা রেসট্রিকশনের মোকাবেলায় ক্ষমতাসীনদের কোন ইতিবাচক ও যৌক্তিক পদক্ষেপ নিতেও দেখা যাচ্ছে না। নিতান্ত একগুয়ের মতো আচরণ করতে দেখা যাচ্ছে তাদের। দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী এই দলের নিকট এমনটি প্রত্যাশিত নয়। আমরা চাই, দেশের জন্য ক্ষতিকর ও লজ্জাজনক যুক্তরাষ্ট্রের এই নিষেধাজ্ঞা তথা নতুন ভিসা নীতি মোকাবেলা তথা প্রত্যাহারে তারা অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন এবং দেশের ১৮ কোটি মানুষকে ক্ষয়ক্ষতি ও লজ্জা-অপমানের পাথার থেকে উদ্ধারে এগিয়ে আসবেন।