দুষ্টচক্রে বন্দী ওষুধের বাজার
প্রকাশিত হয়েছে : ০১ অক্টোবর ২০২৩, ১২:৩০:৩৩ অপরাহ্ন
গতকাল একটি জাতীয় দৈনিকে ‘ওষুধের বাজারে আগুন’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, নিত্যপণ্যের বাজারে আগুন। এর মধ্যে বেড়েছে সব কোম্পানীর ওষুধের দাম। নিয়মিতই ওষুধের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব জমা পড়ছে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরে। ওষুধের দাম বাড়ায় রোগীর চিকিৎসা ব্যয় আরো বাড়ছে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বৃদ্ধিকে ওষুধের দাম বাড়ানোর কারণ হিসেবে বলছে ওষুধ কোম্পানীগুলো।
ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ওষুধের বাজারে প্রায় ১ হাজার ৬৫০ টি জেনেরিকের ২৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার প্রোডাক্ট চালু আছে। এর মধ্যে ১১৭ টি জেনেরিকের ৪৬০ টি ওষুধের দাম ওষুধ প্রশাসন নির্ধারণ করে। অন্যগুলো কোম্পানী খরচ হিসাব করে একটি দাম প্রস্তাব করে। ওষুধ প্রশাসন এতে ভ্যাট সংযোজন করে দাম সমন্বয় করে দেয়।
দেখা যাচ্ছে, প্রতিটি ওষুধ কোম্পানী অধিকাংশ ওষুধের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। নিয়মিতভাবেই এসব্ আবেদন ওষুধ প্রশাসনে জমা দেয় তারা। টেকনিক্যাল কমিটি এবং মূল্য নির্ধারণে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি এগুলো পর্যালোচনা করে অনুমোদন দেয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের তথ্য মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে চিকিৎসা নিতে গিয়ে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় ৬৮ দশমিক ৫০ শতাংশ। এর মধ্যে ৬৪ শতাংশ ব্যয় হয় ওষুধে। সচেতন মহলের মতে, দৈনন্দিন জীবনযাপনের জন্য অপরিহার্য নিত্যপণ্যের উর্ধ্বগতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হু হু করে বাড়ছে প্রয়োজনীয় ওষুধের দাম। এই দৌড়ে পেরে ওঠছে না মানুষ। দেশের শীর্ষ ৬ প্রতিষ্ঠান তাদের উৎপাদিত ২৩৪ টি জীবন রক্ষাকারী ওষুধের দাম ১০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, নির্ধারিত দরের বাজারে অনেক ওষুধ বেশী দামেও কেনাবেচা হচ্ছে। এক্ষেত্রেও দাম বাড়ানোর অজুহাত হিসেবে কোম্পানীগুলো করোনা মহামারি, রাশিয়া ইউক্রেইন যুদ্ধ, বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি, ডলার সংকট, এলসি জটিলতা, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিসহ সরবরাহ সমস্যা, মোড়ক, পরিবহন, বিপণন ব্যয় বৃদ্ধি ইত্যাদিকে প্রদর্শন করছে। সম্প্রতি মিডিয়ায় প্রকাশিত অপর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজধানীর বিভিন্ন ফার্মেসীতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিটি ওষুধের দাম গত কয়েক মাসে ২০ শতাংশ থেকে ৭০ শতাংশ বেড়েছে। ওষুধের দামে কার্যতঃ নৈরাজ্য চলছে। দেখার কেউ নেই। ডাক্তারের পরামর্শে যাদের নিয়মিত ওষুধ খেতে হয় তাদের অনেকেই বলছেন, আগে প্রতি মাসে ওষুধে ২ হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা লাগতো, এখন সেই ওষুধ ক্রয় করতে ৪ হাজার থেকে সাড়ে ৪ হাজার টাকা লাগছে। বাজারে বিক্রি হয় এমন ২৩৪ টি ওষুধের দাম ১০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বাজারে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির দোহাই দিয়ে ওষুধ কোম্পানীগুলো জোর করেই ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি করে। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর ও অনেকটা বাধ্য হয়েই বর্ধিত দাম অনুমোদন করছে।
বলা বাহুল্য, ওষুধ প্রশাসন কিছু সংখ্যক ওষুধের দাম নির্ধারণ করলেও বাজারের বেশীর ভাগ ওষুধের দাম নির্ধারণ করে ওষুধ কোম্পানীগুলো। এভাবে ওষুধের মূল্য নির্ধারণের দায়িত্ব ওষুধ কোম্পানীগুলোকে দেয়ার ফলে তারা ইচ্ছা খুশী ওষুধের দাম বাড়াচ্ছে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে ওষুধের দাম বাড়লেও সেটা কতো শতাংশ বাড়া যৌক্তিক তা নির্ধারণ না করেই মূল্যবৃদ্ধিতে অনুমোদন দিচ্ছে প্রশাসন।
অনেক ক্ষেত্রে ওষুধ কোম্পানী ও ব্যবসায়ীরা নির্ধারিত দামের তোয়াক্কা না করেই ইচ্ছে খুশীমতো দামে ওষুধ বিক্রি করছে। যখন সরকারের বেঁধে দেয়া দামে ডিম, আলু ইত্যাদি বিক্রি করছেন না বা সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের কারসাজির দরুন বিক্রি করতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা, তখন ওষুধ কোম্পানীর মতো প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান ও তাদের মালিকদের নির্ধারিত মূল্যে ওষুধ বিক্রিতে বাধ্য করা কি কর্তৃপক্ষের পক্ষে আদৌ সম্ভব? এমনকি ফার্মেসী ব্যবসায়ীদেরও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না কর্তৃপক্ষের পক্ষে। অন্যান্য নিত্যপণ্য ও সেবার মতো অপরিহার্য পণ্য ওষুধও এখন একটি অসৎ সিন্ডিকেটের হাতে বন্দী বা জিম্মি। ফলে অসহায় রোগীরা, অসহায় সাধারণ জনগণ। এই অসৎ চক্রের খপ্পর থেকে কে করবে তাদের উদ্ধার? এমন প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে দেশজুড়ে।