দেশজুড়ে রাসেলস ভাইপার শংকা
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ জুন ২০২৪, ১২:৩৫:৪৬ অপরাহ্ন
গতকাল জাতীয় মিডিয়ায় ‘২৮ জেলায় ছড়িয়েছে রাসেলস ভাইপার’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, দেশের প্রায় ২৮ টি জেলায় বিষধর রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সাপ ছড়িয়ে পড়েছে। শুধু জাতীয় মিডিয়ায় নয়, এ নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। বিবিসি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সাপের কামড়ের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার খবরের পর দেশটির সব স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও হাসপাতালকে অ্যান্টিভেনম মজুত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাপের কামড়ের শিকার ব্যক্তিদের যতো দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নিয়ে আসার জন্য জনগণের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। বিবিসি বলেছে, বাংলাদেশের গ্রামীণ হাসপাতালগুলো থেকে সাপের কামড়ের শিকার রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধির তথ্য জানানো হচ্ছে। এর মধ্যে বেশীর ভাগই দক্ষিণ এশিয়ায় পাওয়া রাসেলস ভাইপার সাপের কামড়ের শিকার।
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ফেইসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও রাসেলস ভাইপার নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও হৈ চৈ হচ্ছে। এ নিয়ে মানুষের মাঝে শংকা সৃষ্টির লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে। আর এ ধরনের শংকা ও উদ্বেগের বিষয়টি অযৌক্তিক বলা যাবে না। কারণ ইতোমধ্যে এই বিষধর সাপের কামড়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে বেশ কিছু লোকের মৃত্যু ঘটেছে। গত ১১ জুলাই ফরিদপুরে জনৈক সাপুড়ে নজরুল রাসেলস ভাইপারের কামড়ে মারা যান। তিনি সাপটিকে অজগরের বাচ্চা ভেবেছিলেন। গত ১৩ এপ্রিল একই জেলার চরভদ্রাসন উপজেলায় রাসেলস ভাইপারের কামড়ে জনৈক কৃষকের মৃত্যু হয়। উভয়ক্ষেত্রেই বেশ ব্যয়বহুল চিকিৎসা সত্বেও আক্রান্তরা মারা যান। ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড ¯েœক কনজারভেশন ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে চন্দ্রবোড়া অর্থাৎ রাসেলস ভাইপার, রাজ গোখরা, পদ্ম গোখরা, কাল কেউটে, দাঁড়াশ, অজগর, ঢোড়া, শঙ্খিনি ইত্যাদি সহ প্রায় ৯০ প্রজাতির সাপ আছে। এর মধ্যে ২৬ প্রজাতির সাপ বিষধর।
বছর তিনেক আগে বাংলাদেশের একটি জাতীয় পত্রিকায় ‘নড়িয়ার ড্রেজারে রাসেলস ভাইপার এলো কী করে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, রাসেলস ভাইপার শ্রীলংকার কিছু অঞ্চল, ভারতের কিছু অংশ, মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া ও কম্বোডিয়ায় পাওয়া যায়। বাংলাদেশে রাসেলস ভাইপার গঙ্গা-পদ্মা নদীকে আশ্রয় করে বেঁচে আছে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে নতুন করে এ সাপটি বাংলাদেশে ঢুকছে। রাসেলস ভাইপার কোন মানুষকে কামড়ালে তার দেহে রক্ত জমাট বাঁধতে দেয় না। কিডনী বিকল হয়ে পড়ে। রক্তচাপ কমে যায়। এই সাপের কামড়ে মৃত্যুহার অনেক বেশী। নতুন আবির্ভুত এই বিষধর সাপ নতুন সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। সাপের কামড়ে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছে রাসেলস ভাইপার। বাংলাদেশ টক্সিকোলজি সোসাইটির প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক এম এ ফয়েজ বলেন, সর্প দংশনের সমস্যাকে ‘জনস্বাস্থ্য সমস্যা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। দেশে যে অ্যান্টিভেনস রোগীদের দেয়া হচ্ছে তা রাসেলস ভাইপারের ক্ষেত্রে কতোটুকু কার্যকর তা খতিয়ে দেখতে হবে।
উল্লেখ্য, প্রতি বছর বিশ্বে বিষধর সাপের কামড়ে প্রায় ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। আর সাপের কামড় সত্বেও বেঁচে গেলেও বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় ভোগেন অনেক সাপে কাটা রোগী। সাড়ে কামড়ালেও তার জন্য সঠিক অ্যান্টিভেনম না পাওয়া এতো মৃত্যু হারের কারণ। প্রজাতিভেদে অ্যান্টিভেনম আলাদা হওয়ার ফলে অনেকক্ষেত্রে দংশনকারী সাপ চিহ্নিত করা যায় না। ফলে সঠিক অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করা যায় না। আবার কিছু প্রজাতির সাপের অ্যান্টিভেনমও খুঁজে পাওয়া যায় না। বাংলাদেশে প্রতি বছর ৪ লক্ষাধিক মানুষকে সাপে কামড় দেয়। তাদের মধ্যে মারা যায় ৭ হাজার জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ ইউনিটের এক গবেষণায় দেখা গেছে, সাপের কামড়ের সব ঘটনার মধ্যে এক চতুর্থাংশ বিষাক্ত, যাদের ১০ দশমিক ৬ শতাংশ শারীরিক ও ১ দশমিক ৯ শতাংশ কামড়ের শিকার রোগী মানসিক অক্ষমতায় আক্রান্ত হয়। সাপের কামড়ের মধ্যে ৯৫ শতাংশ ভুক্তভোগী গ্রামীণ অঞ্চলের এবং নারীদের তুলনায় পুরুষের সাপের কামড়ের ঝুঁকি বেশি। গত বছর তৎকালীন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালিক বলেন, সাপের কামড়ে মৃত্যুর সংখ্যাটি অনেক বড়। দেশে একটি ভেনম সংগ্রহ কেন্দ্র আছে। আমাদের অ্যান্টিভেনম উৎপাদনের ব্যবস্থা নিতে হবে।
উল্লেখ্য, রাসেলস ভাইপার সাপের নামটির সাথে জড়িয়ে আছে আঠারো শতকের ব্রিটিশ সর্পবিদ বা সর্প গবেষক প্যাট্রিক রাসেলের নাম। স্কটিশ সার্জন ও প্রকৃতিবিদ প্যাট্রিক রাসেল ভারতে কর্মরত ছিলেন। তাকে ‘সর্পবিদ্যার জনক’ও বলা হয়। তিনি সাপ নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করেন। তার নামেই রাসেলস ভাইপার সাপের নামকরণ করা হয়েছে।