সম্পাদকীয় : অরক্ষিত বিদ্যুতে প্রাণহানি
প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ জুলাই ২০২৪, ১২:৩৫:০৩ অপরাহ্ন

গত রোববার রথযাত্রায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ৩ নারীসহ ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন অন্তত: ২০ জন। অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও মর্মান্তিক এ ঘটনা। দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারের সদস্য ও স্বজনরাই জানে এমন মৃত্যুর যাতনা ও গভীরতা কতোটুকু। ইদানিং সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যুর ঘটনা বাড়তে দেখা যাচ্ছে। মেঘ বৃষ্টি ও বন্যা এ ধরনের অপমৃত্যুর একটি বড় কারণ হতে দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টি বাদলা ও ঝড় তুফানের দিন শুরু হওয়ার পর বিশেষভাবে গত জুন মাসের শুরু থেকে সিলেটসহ সারাদেশে বহু লোক বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গেছেন। দেখা গেছে, বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে পড়ে, ছেঁড়া তারে জড়িয়ে কিংবা কাজ করতে গিয়ে বিদ্যুতের তারের সংস্পর্শে এসে অনেকে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। এছাড়া বন্যার পানিতে ডুবে থাকা বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে মারা গেছে অনেক লোক।
গত ২৭ জুন সিলেট জেলার বিয়ানীবাজারে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে জুয়েল মিয়া নামক জনৈক শ্রমিক মারা যান। এ সময় আহত হন আরো দু’জন। বিয়ানীবাজার পৌর এলাকার খাসাড়িপাড়ায় একটি রড সিমেন্টের দোকানে এ ঘটনা ঘটে। হতাহতরা সড়কের পাশে দোকানের বাঁকা রড সোজা করার কাজ করছিলেন। এমন সময় একটি রড বিদ্যুতের তার স্পর্শ করলে তিনজনই বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন। মারা যান এদের একজন। এছাড়া গত ১৯ জুন সিলেটের বিছনাকান্দির উপরগ্রামে নাজমিন আক্তার নামে এক শিশু বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে প্রাণ হারায়। ঐদিনই সিলেটের দক্ষিণ সুরমার ঝালোপাড়ায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে হয়ে মিনতি রাণী (৪০) নামের এক নারীর মৃত্যু হয়। পানির পাম্পে সুইচ দিতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান তিনি।
এর আগে মার্চে মৌলভীবাজারের বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে পড়ে একটি ঘরের টিনের চালে। এতে আগুন ধরে গেলে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ও আগুনে দগ্ধ হয়ে একই পরিবারের ৫ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। গত ১৪ জুন সিলেটের জৈন্তাপুরে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে পানিতে পড়ে মারা যান ফাহাদ নামক জনৈক যুবক।
এছাড়া গতকাল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলায় কাটা গাছের টুকরো ক্রেনে করে ট্রাকে উঠানোর সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে চালক ও তার সহকারী মারা যান। গত ৫ জুলাই কুড়িগ্রামের নাগেশ্বর উপজেলার কচাকাটা থানা এলাকায় পৃথক ঘটনায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে দুই বোনসহ তিনজন নিহত হন। বাড়ির অদুরে সেচ পাম্পের টাঙ্গানো বিদ্যুতের তারে দুই বোনের গলা আটকে যায়। এতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলেই শিশু দু’জন মারা যায়। এছাড়া একই সময়ে একই জেলার নারায়নপুর ইউনিয়নের বেপারিপাড়া গ্রামের সিরাজুল ইসলাম পানিতে ভেলায় করে পাশের বাড়িতে যাওয়ার সময় হাতের লগি বিদ্যুতের মেইন লাইন স্পর্শ করলে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে তার মৃত্যু হয়।
এভাবে প্রতি বছর এদেশে নানাভাবে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে বহু লোকের মৃত্যু ঘটে। অনেকে আহত এমনকি পঙ্গু হন। অনেকের হাত কেটে ফেলতে হয়। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে বাড়িঘর সহ বিভিন্ন স্থাপনায় বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা পরিদর্শন ও পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য বিদ্যুৎ পরিদর্শক রয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশে এমন কোন পরিদর্শন বা পরিদর্শনের ব্যবস্থা না থাকায় প্রায়ই বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনা ঘটছে। শর্ট সার্কিট থেকে অগ্নিকান্ড ঘটে প্রতি বছর। বহু বাড়িঘর ও দোকানপাট ও প্রতিষ্ঠান পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ তদন্তের সুষ্ঠু ব্যবস্থা না থাকায় এসব সংযোগ থেকেও বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনা ঘটছে। এতে প্রাণহানি হচ্ছে।
বলা বাহুল্য, এদেশে একবার বৈদ্যুতিক সংযোগ নেয়া হলে কিংবা বৈদ্যুতিক ওয়্যারিংয়ের কাজ করার পর বছরের পর বছর এগুলো আর পরীক্ষা করা হয় না। দেখা হয় না ক্যাবল বা তারে কিংবা সংযোগে কোন ত্রুটি বা সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে কিনা। বিশেষভাবে কনসিল ওয়্যারিং অর্থাৎ দেয়ালের ভেতরে বা স্থাপিত বৈদ্যুতিক তারগুলো পরীক্ষার কোন নিয়ম বা রেওয়াজ নেই বললেই চলে এদেশে। এতে ঘটে মারাত্মক দুর্ঘটনা।
সর্বোপরি ঘরদোর ও স্থাপনার বাইরে খুঁটিনির্ভর লাইনগুলোর অধিকাংশই নাজুক ও ত্রুটিপূর্ণ। দুর্বল লাইন দিয়ে চলছে বিদ্যুৎ সরবরাহের কাজ। ফলে প্রায়ই সামান্য ঝড়তুফান এমনকি বৃষ্টিতে ছিঁড়ে পড়ছে বিদ্যুতের তার। দেশব্যাপী এসব অরক্ষিত ও ত্রুটিপূর্ণ বৈদ্যুতিক লাইন ও সংযোগের সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণ ও পরীক্ষা নিরীক্ষা এখন অতীব জরুরী ও সময়ের দাবি। যে হারে বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে এ অবস্থায় এদিকে আর উদাসীনতা ও অবহেলা হবে জাতীয়ভাবে আত্মঘাতী।


