জয়ের দুর্নীতির বিজয়পতাকা
প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:৩০:৪৪ অপরাহ্ন
একটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংশ্লিষ্ট দেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র। তা ব্যাংক অব ইংল্যা- কিংবা বাংলাদেশ ব্যাংক যা-ই হোক না কেনো। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার বাংলাদেশের ব্যাংক খাত তথা অর্থনীতির এই প্রাণ ভোমরাটি ছিলো সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র সজিব ওয়াজেদ জয়ের হাতে। গতকাল একটি জাতীয় মিডিয়া ‘বাংলাদেশ ব্যাংকে অনেক কিছুরই অদৃশ্য নীতি নির্ধারক ছিলেন সজীব ওয়াজেদ জয়’ শিরোনামে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের পদস্থ অফিসারদের কাছে জয়ের এই হস্তক্ষেপ ছিলো পরিচিত ও জ্ঞাত একটি বিষয়। কেনাকাটা, নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স প্রদান, বিতর্কিত শিল্প গ্রুপগুলোর ঋণ পুনঃতফশীলকরণ এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকের বড়ো অংকের ঋণ অনুমোদনের মতো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনেক নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করতেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র জয়। এসব কাজে কখনো সরাসরি গভর্ণরকে ফোন করতেন তিনি। আবার কখনো ডেপুটি গভর্নর কিংবা নির্বাহী পরিচালক পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের কাছেও জয়ের ফোন আসতো। কখনো কখনো সালমান এফ রহমানের মাধ্যমেও হস্তক্ষেপ করতেন সজীব ওয়াজেদ জয়।
সংশ্লিষ্ট সবপক্ষ বলেছে, সজীব ওয়াজেদ জয়ের নির্দেশনা আসতো মোবাইল ফোনের মাধ্যমে। এক্ষেত্রে সরাসরি কল না করে হোয়াটস অ্যাপ, স্কাইপের মতো অ্যাপের মাধ্যমে সংযুক্ত হয়ে তিনি নির্দেশনা দিতেন। এ কারণে তার লিখিত কোন প্রমাণ থাকতো না। তবে ডঃ আতিউর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, গভর্ণর থাকা অবস্থায় নিজে থেকেই প্রতি মাসে জয়ের কাছে কর্মতৎপরতার প্রতিবেদন পাঠাতেন তিনি। ভবিষ্যতে অর্থমন্ত্রী হওয়ার লোভে তিনি এমনটি করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়া দেড় দশকে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে। তবে বেশির ভাগ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন হয়েছে। এক্ষেত্রে সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার কেনার বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট করে দেয়া থেকে শুরু করে নীতি নির্ধারণী অনেক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেই জয়ের হস্তক্ষেপ থাকতো। জয়ের পরামর্শেই গভর্ণর আতিউর রিজার্ভের অর্থ উদ্ধারের জন্য ভারতীয় নাগরিক রাকেশের প্রতিষ্ঠানকে পরামর্শক নিয়োগ দেন, যারা তথ্যপ্রমাণ ধ্বংস করে দেয়। রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংকের লাইসেন্স প্রদানে জয়ের খায়েশ পূরণে তৎপর ছিলেন গভর্ণর আতিউর। আতিউর ওই সময় আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীসহ বিভিন্ন দলীয় সমাবেশে গিয়েও বক্তব্য রাখেন। গভর্ণরের রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণেই রাষ্ট্রায়াত্ব ব্যাংকগুলোর চেয়ারম্যান, পরিচালকরা অনিয়ম দুর্নীতিতে উৎসাহিত হয়েছিলেন। পরিচালনা বোর্ডের চাপের কারণে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষও নানা অনিয়মে জড়িয়েছে। ওই সময় বেসিক ব্যাংক লুট, সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেংকারী, জনতা ব্যাংকে বিসমিল্লাহ গ্রুপ, এননটেক্স ও ক্রিসেন্ট কেলেংকারির মতো বৃহৎ কেলেংকারির ঘটনা ঘটেছিলো। গত জুনের শুরুতে দেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল ব্যাংক হিসাবে নগদ ডিজিটাল ব্যাংক পিএলসি’র লাইসেন্স ইস্যু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই ব্যাংকের অনুমোদন প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রেও সজীব ওয়াজেদ জয়ের হস্তক্ষেপ ছিলো বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। হাসিনা সরকারের শেষ বি-বি গভর্নর ছিলেন আব্দুর রউফ তালুকদার। তার ভূমিকা ছিলো রাজনৈতিক কর্মীর মতো। সরকারের পক্ষ থেকে যে নির্দেশনা আসতো, তিনি কেবল সেটিরই বাস্তবায়ন করতেন। তিনি জয়ের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাসে তিনিই একমাত্র গভর্ণর, যিনি রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর পালিয়েছেন।
উপরোক্ত ঘটনাবলী থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো দেশের অর্থনীতির নীতি নির্ধারক প্রতিষ্ঠান ও অর্থনীতির পাওয়ার হাউসটিতে কীভাবে স্বৈরশাসক হাসিনা ও তার পুত্র জয় দুর্নীতির বিজয়ের পতাকা উড়িয়েছিলো, ধ্বংস করে দিয়েছিলো দেশের অর্থনীতিকে।