দুর্নীতির বোমা বিস্ফোরিত শ্বেতপত্রে
প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:৩০:৩৫ অপরাহ্ন
সম্প্রতি প্রকাশিত শ্বেতপত্রে যেসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে, তা রীতিমতো ভয়াবহ। গত দেড় দশকের স্বৈরাচারী শাসনামলে দেশকে যেভাবে লুট করা হয়েছে, তা ব্রিটিশ ও পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর অর্থনৈতিক শোষণ লুন্ঠনকেও ছাড়িয়ে গেছে, এমন অভিমত অনেক বিশ্লেষকের। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গঠিত শ্বেতপত্র কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, বাংলাদেশে উন্নয়ন বাজেটের ৪০ শতাংশ অর্থ তসরুফ করা হয়েছে স্বৈরাচারী সরকারের শাসনামলে। আর দেশের ১০ শতাংশ মানুষ ৮৫ সম্পদ ভোগ করছেন।
প্রধান উপদেষ্টার কাছে গত রোববার জমা দেয়া বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা বিষয়ক শ্বেতপত্রের খসড়ায় বলা হয়েছে, নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত ১০টি ব্যাংকের সবগুলোই টেকনিক্যালী দেউলিয়া ও অচল।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, এই ১০টি ব্যাংকের মধ্যে রয়েছে ২টি রাষ্ট্রায়াত্ব ব্যাংক, যেগুলো গত দশকে কেলেংকারীর শিকার হয়েছে। বাকী ৮টি অত্যন্ত দুর্বল শরিয়াভিত্তিক ব্যাংক ও প্রচলিত বেসরকারী বাণিজ্যিক ব্যাংক। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, বাংলাদেশে একটি ৪ লেইনের শহুরে মহাসড়ক নির্মাণের ব্যয় ভারতের চেয়ে ৪.৪ গুণ এবং পাকিস্তানের চেয়ে ২.১৫ গুণ বেশী। বাংলাদেশের নির্মাণ ব্যয় এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশের তুলনায় উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেশী, অথচ অবকাঠামোর মান তুলনামূলকভাবে নি¤œ।
লুটেরা স্বৈরাচারী হাসিনার সরকারের গত ১৫ বছরের আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির পরিসংখ্যান যেমন বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন তেমনি অর্থনীতির জন্য স্থায়ী ক্ষতির কারণ। কবে ও কীভাবে বাংলাদেশ এই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠতে পারবে তা বলা মুশকিল।
যে উন্নয়ন বাজেটের কথা বলা হয়েছে, সেই প্রসংগে একটা কথাই যথেষ্ট যে, শেখ হাসিনার সরকার উন্নয়ন খাতে অর্থ বরাদ্দ করতো মূলত: লুটপাটের জন্য। যতো বেশী প্রকল্প হাতে নেয়া হতো ততো লাভ হতো হাসিনা, তার পরিবারের সদস্য ও তার স্বার্থের ভাগিদার নেতামন্ত্রী এমপি ও অলিগারদের। আর তারা বেছে বেছে এমন সব প্রকল্প গ্রহণ করতো, যা থেকে প্রচুর অর্থ লুট করা যায়, সেগুলোতে দেশের তেমন কোন ফায়দা হোক বা না হোক।
এক্ষেত্রে কর্ণফুলী টানেলের কথা বলছেন সচেতন মহল। এ ধরনের আরো বহু প্রকল্প রয়েছে যেগুলো যেমন অপ্রয়োজনীয় তেমনি অগ্রাধিকার বিবেচনায় অনেক পেছনের সারিতে থাকার কথা। এমনকি পদ্মা সেতু নিয়ে দেশব্যাপী হৈ চৈ তোলপাড় হয়েছে, সেটা করার আগে দেশের লক্ষ লক্ষ বেকারের কর্মসংস্থান, শিল্পায়ন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং ব্যবসা বাণিজ্যে বিনিয়োগ ছিলো জরুরী। কিন্তু দেশের দুর্ভোগ পীড়িত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সমস্যার প্রতি বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে ঋণ করে লক্ষ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে এসব মেগা প্রকল্পে। ফলে দেশে আয় বৈষম্য আরো বেড়েছে। দরিদ্র মানুষ আরো দরিদ্র হয়েছে। একশ্রেণীর মানুষ বিশেষভাবে ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাসীনদের ঘনিষ্ঠ লোকজন অর্থবিত্তে ফুলে ফেঁপে ওঠেছে। তাদের লুন্ঠিত অর্থ বেশীর ভাগই পাচার হয়ে গেছে বিদেশে। এই ১০ ভাগ মানুষের কাছে পুঞ্জিভূত হয়েছে ৮৫ ভাগ সম্পদ।
তাদের লুন্ঠনের সবচেয়ে বড়ো ক্ষেত্র ছিলো ব্যাংক খাত। এক সময় বাংলাদেশের ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো ছিলো সবচেয়ে সমৃদ্ধ ও দৃঢ় অর্থনৈতিক ভিত্তির অধিকারী। তাই এই লুটেরা গোষ্ঠীর শ্যেন দৃষ্টি পড়ে এগুলোর ওপর। তাদের নজিরবিহীন লুটপাটের ফলে এসব ব্যাংকের অধিকাংশই এখন প্রায় দেউলিয়া হয়ে পড়ে। হাসিনা সরকার ব্যাংক খাত নিয়ে মিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশেও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলো। অনেক সাংবাদিককে এজন্য জেল জুলুমের শিকার হতে হয়েছে। প্রায় বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত ব্যাংক খাতকে পুনরুদ্ধার করতে প্রাণপন চেষ্টা করতে হচ্ছে বর্তমান সরকারকে। অক্লান্ত চেষ্টায় ব্যাংক খাতের উন্নতি হচ্ছে। রিজার্ভের অবস্থাও ক্রমশ: ভালো হচ্ছে। রিজার্ভে হাত না দিয়েও ইতোমধ্যে কয়েক বিলিয়ন ডলার ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে সক্ষম হয়েছে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এভাবে চললে আগামী কয়েক মাসে দেশের অর্থনীতি গোড়া থেকে অনেকখানি সংস্কার ও মজবুত হওয়ার প্রত্যাশা করা যায়। মূল্যস্ফীতি এখনো উচ্চ রয়ে গেছে। তবে অর্থনীতির গোড়া মজবুত ও শক্তিশালী হলে এক পর্যায়ে মূল্যস্ফীতির মতো উপরের স্তরের সমস্যাও দূর হতে শুরু করবে, এমন আশাবাদ সংশ্লিষ্ট মহলের। শ্বেতপত্রের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির বড়ো বড়ো অসংগতি, অনিয়ম ও দুর্বলতাগুলো প্রকাশিত হয়েছে। এখন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এগুলো সমাধানের উদ্যোগ নেয়া হলে অর্থনীতির চেহারা অনেকটাই পাল্টে যাবে, এতে কোন সন্দেহ নেই। জনগণ সেই প্রত্যাশা নিয়ে অপেক্ষায় আছে।