জকিগঞ্জে শুষ্ক মৌসুমেও সুরমা-কুশিয়ারায় ভাঙন, শতশত একর জায়গা হারাচ্ছে দেশ
প্রকাশিত হয়েছে : ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯:২৬:৪২ অপরাহ্ন
এখলাছুর রহমান, জকিগঞ্জ: সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলায় ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষে বয়ে যাওয়া সুরমা-কুশিয়ারা নদীর ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। চোখের সামনে নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে ফসলি জমিসহ বসতভিটা।
ভাঙন কবলিত এলাকা থেকে কিছুদিনের মধ্যে ঘরবাড়ি সরাতে না পারলে সব কিছুই সুরমা-কুশিয়ারা গিলে খাবে নদী এমন আশঙ্কাও রয়েছে। গেল বর্ষা মৌসুমে চার দফা বন্যার পর এবার শুষ্ক মৌসুমে ভয়াবহ নদী ভাঙনে অসহায়ত্ব ভেসে উঠছে সীমান্ত উপজেলার মানুষের চোখে-মুখে। একদিকে দেশের মানচিত্র ছোট হচ্ছে আর অন্যদিকে লোকজন হারাচ্ছেন তাদের জায়গা জমি।
তিনদিক আন্তঃসীমান্ত নদী বেষ্টিত এ উপজেলার বেশিরভাগ এলাকায় নদী ভাঙনের চিত্র ভয়াবহ। ইতোমধ্যে বিভিন্ন গ্রাম, জনপদ, কৃষিজমি, ঘরবাড়ি, হাটবাজার, সড়ক, অনেক অবকাঠামো, মসজিদ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর গোরস্থান নদীতে বিলিন হয়েছে। কয়েক বছরের ভাঙনে সুরমা-কুশিয়ারা নদী এখন বাংলাদেশ সীমান্তের অন্তত এক-দুই কিলোমিটার ভেতর দিয়ে বয়ে চলছে। বাংলাদেশের বহু জমি ভারতের সীমানায় চলে গেছে। চোখের সামনেই সেই জমিতে ভারতীয়রা চাষাবাদ করছেন। আন্তঃসীমান্ত নদীর ভাঙ্গনের কবলে পড়ে শতশত একর জায়গা হারাচ্ছে দেশ। হাজারো পরিবার বসতভিটা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তবুও ভাঙ্গন পিছু ছাড়ছেনা সীমান্তবাসীর। ভাঙ্গনের কবলে পড়ে ভূমিহীনরা এখন অনেক দুঃখ কষ্টে জীবনযাপন করছেন। এ নিয়ে ক্ষোভের শেষ নেই সাধারণ মানুষের মনে। পুরো উপজেলার অর্ধশতাধিক স্থানে রয়েছে ভাঙ্গনের ভয়াল চিত্র।
উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এবার শুষ্ক মৌসুমে পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে কুশিয়ারা নদীর জকিগঞ্জ পৌরসভার কেছরী, মাইজকান্দি, জকিগঞ্জ বাজার, ছয়লেন, নরসিংহপুর ও হাইদ্রাবন্দ গ্রাম; খলাছড়া ইউপির ভুঁইয়ারমুড়া পশ্চিম লোহারমহল, কাপনা, গাগলাজুর, সুনাপুর, বেউর; জকিগঞ্জ সদর ইউনিয়নের ছবড়িয়া, মানিকপুর, ভাখরশাল, শষ্যকুঁড়ি, সেনাপতিরচক, লালোগ্রাম, রারাই; সুলতানপুর ইউপির খাদিমান, অজরগ্রাম, সুলতানপুর, ইছাপুর, খাদিমান, গঙ্গাজল, ভক্তিপুর, সহিদাবাদ, রহিমপুর; বিরশ্রী ইউনিয়নের সোনাপুর, পিয়াইপুর, পীরনগর, লক্ষীবাজার, বড়চালিয়া, উজিরপুর, কোনাগ্রাম, মাজরগ্রাম, লাফাকোনা, বড়পাথর, জামডহর, সুপ্রাকান্দী, বারঠাকুরী ইউপির পিল্লাকান্দী, সুরমা নদীর উত্তরকুল, লাড়িগ্রাম, আমলশীদ, বারঠাকুরী, বিন্নাপাড়া, ছালেহপুর; কসকনকপুর ইউপির বলরামেরচক, হাজিগঞ্জ, মুন্সিপাড়া, মিয়াগুল, চেকপোস্ট, মৌলভীরচক, বলরামেরচক, মিয়াগুল, বিয়াবাইল, ইনামতি, বিয়াবাইল; মানিকপুর ইউপির হরাইত্রিলোচন আকাশমল্লিক, বাল্লা, রঘুরচক; কাজলসার ইউনিয়নের নালুহাটি, বড়বন্দ, আটগ্রাম; বারহাল ইউপির চক, নিজগ্রাম, পুটিজুরি, শরীফাবাদ, শাহবাগ, বারইগ্রাম, চককোনাগ্রাম, নোয়াগ্রামে ভয়াবহ ভাঙন রয়েছে। তাছাড়াও কিছু এলাকাতে দীর্ঘদিন ধরে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ সংস্কার না করায় নদীর পানির স্তরের বিপদসীমার নিচে নেমে গেছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। এতে বর্ষা মৌসুমে বাঁধ উপচে নদীর পানি লোকালয়ে প্রবেশ করে।
বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভারত থেকে বরাক নদী আমলশীদে এসে সুরমা-কুশিয়ারা দুটি নদীতে রূপ নিয়েছে। প্রতি বর্ষা মৌসুমে ভারতের উজানের ঢল বরাক নদী হয়ে এ দুটি নদীতে আসে। এরপর প্রায় ৭০ ভাগ পানি কুশিয়ারা ও ৩০ ভাগ পানি সুরমা দিয়ে সিলেট বিভাগের প্রায় ১০০টি নদ-নদীতে পানি প্রবাহিত হয়। বরাক হয়ে ভারতের পাহাড়ী ঢল নামার সঙ্গে সঙ্গেই জকিগঞ্জের বিভিন্ন এলাকার নদী ভাঙন দেখা দেয়। চলতি বছরে বরাক নদী দিয়ে আসা ভারতের ঢলে জকিগঞ্জে পরপর চারবার বাঁধ ভেঙে তলিয়ে যায় পুরো উপজেলা। বন্যার ক্ষত মুছে যায়নি এখনো। এরমধ্যে শুষ্ক মৌসুমে নদীর পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে নদীতে ধসে পড়ছে বাংলাদেশের জায়গা। তাই, বসতভিটা হারানোর উৎকণ্ঠায় দিন পার করছেন নদী পাড়ের বাসিন্দারা।
নদী ভাঙন নিয়ে বিভিন্ন এলাকার প্রবীণ লোকজনের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, সীমান্ত নদী দুটির ভাঙন রোধে সরকারের কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। আমাদের বাংলাদেশের ভূমি ভেঙে ভারতে চর জেগে ওঠছে। এই অবস্থা চলছে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকেই। ভারতের করিমগঞ্জকে নদী ভাঙন থেকে রক্ষার জন্য ভারত সেদিকের তীরে শক্ত গ্রোয়েন নির্মাণ করেছে বহুবছর আগে। এ কারণে নদীর প্রবল স্রোত এখন সরাসরি বাংলাদেশের তীরে আছড়ে পড়ে আমাদের ভূমি ধসে যায় নদীতে। এতে দিনদিন ভারতের অংশে বিশাল তীর জেগে উঠছে। বাংলাদেশের জায়গা ভেঙ্গে ভারতের ওপারে সৃষ্টি হওয়া বিশাল তীরে সে দেশের লোকজন সারি সারি সুপারি গাছ রোপণ করেছেন এবং শাক সবজি চাষ করছেন। অনেক এলাকায় বিএসএফ নদীর তীরে চৌকি বসিয়েছে। টানা চারবারের বন্যার ক্ষয়ক্ষতি এখনো দৃশ্যমান। এরমধ্যে শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই নতুন করে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বাড়িঘর, হাটবাজার, স্কুল, মসজিদ, রাস্তাঘাটসহ ফসলি জমি নদী ভাঙনের ঝুঁকিতে আছে। ভাঙন রোধের উদ্যোগ দ্রুত না নিলে কয়েকদিনের মধ্যে বাংলাদেশের শতশত একর জমি ভারতের সঙ্গে অর্ন্তভূক্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, জকিগঞ্জে কুশিয়ারা নদীর ডান তীরে ৪১ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ ভাঙন চলছে। এর মধ্যে ভক্তিপুরে ৫০০ মিটার, মানিকপুর বাখরশালে ৮০০ মিটার, শষ্যকুঁড়িতে ৭০০ মিটার, শেখ পাড়ায় ২৫০ মিটার, উজিরপুরে ৪০০ মিটার, লক্ষীরারচকে ৫৫০ মিটার, সুনাপুরে ৪০০ মিটার, সুপ্রাকান্দিতে ৪০০ মিটার, গাগলাজুরে ২০০ মিটার, লোহার মহলে ৩৫০ মিটারসহ ১০টি স্থানে প্রায় ৪ দশমিক ৬০ কি.মি। জকিগঞ্জ উপজেলায় ‘সীমান্ত নদীর তীর সংরক্ষণ ও উন্নয়ন (২য় পর্যায়)’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় চারটি প্যাকেজে সুপ্রাকান্দি, মানিকপুর, রারাই সেনাপতির চক, বড়চালিয়া ও রহিমপুর নামক স্থানে ১ দশমিক ৮০০ কি.মি. নদীর তীর সংরক্ষণ কাজের মধ্যে দুটি প্যাকেজের কাজ শেষ হয়েছে। অপরটি চলমান। এ ছাড়া ‘বন্যা ব্যবস্থাপনা পুনর্গঠন জরুরি সহায়তা’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় জকিগঞ্জ উপজেলায় কুশিয়ার নদীর ডান তীরে ৪১ কি.মি. বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের পুনর্বাসন কাজ ও অতি ভাঙনপ্রবণ এলাকায় নদীর তীর প্রতিরক্ষা কাজের প্রস্তাবনা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবরে প্রেরণ করা হয়েছে।
সূত্রটি আরও জানায়, সিলেটের সুরমা-কুশিয়ারা নদীর ভাঙন রোধ ও বন্যা ঠেকাতে বেড়িবাঁধ নির্মাণে ইতোমধ্যে ৪৫০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর পাঠানো হয়েছে। প্রকল্পটি অনুমোদনের অপেক্ষায়। ভাঙন রোধের জন্য জরুরি ভিত্তিতে এখন কুশিয়ারা নদীর ছয় কিলোমিটার এলাকায় ব্লক বসাতে হবে। এর জন্য ৩০০ কোটি টাকার প্রয়োজন। চলতি বছরের বন্যার পর নতুন করে কয়েক কিলোমিটার জায়গা সুরমা-কুশিয়ারা নদীতে বিলিন হয়েছে।
জকিগঞ্জ সদর ইউপির সদস্য ছবড়িয়া গ্রামের আব্দুল মুকিত বলেন, আমাদের গ্রামের বহু পরিবারের জায়গা ভারতে চলে গেছে। বসতভিটাহীন মানুষজন এখন অন্যের জায়গার ওপর বসবাস করছেন। কেউ কেউ অন্যত্র সরে গেছেন। কুশিয়ারা নদীর বাঁক এখন ছবড়িয়া গ্রামের ভেতর দিয়েই যাচ্ছে। তবুও ভাঙন থামেনি। ছবড়িয়া গ্রামের সৈয়দ আমিরুল ইসলাম মাদানী আল হুসাইনি রা. এর মাজার ভাঙ্গনে হুমকিতে রয়েছে। ভাঙন রোধের উদ্যোগ দ্রুত না নিলে তীরবর্তী অনেক গ্রামের অস্তিত্ব মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে পারে।
জকিগঞ্জ পৌর এলাকার কেছরী গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা রিয়াজ উদ্দিন বলেন, ছোটবেলায় কুশিয়ারা নদী জকিগঞ্জ বাজার থেকে অনেক দূরে দেখেছেন। কিন্তু কয়েক বছরের ব্যবধানে জকিগঞ্জ বাজারের অনেক জায়গা নদীতে চলে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় জকিগঞ্জ শহর কুশিয়ারা নদীতে বিলিন হয়ে যাবে।
এ নিয়ে কথা হয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী শফিকুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, জকিগঞ্জের পরিস্থিতি আসলে খুবই ভয়াবহ। ভাঙন ঠেকানোর জন্য আমরা চেষ্টায় আছি। উচ্চমহলকেও জানানো হয়েছে।