আদিবাসী বিতর্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:৩০:১২ অপরাহ্ন
সম্প্রতি স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে উল্লেখিত ‘আদিবাসী’ শব্দ বাদ নিয়ে এদেশের সচেতন মানুষের মাঝে ক্ষোভ দেখা দেয়। এ নিয়ে গত ১৫ জানুয়ারি ঢাকার মতিঝিলে এনটিসিবি ভবনের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে কিছু ছাত্র জনতা। একই দিনে সংক্ষুব্দ আদিবাসী ছাত্র জনতা’র ব্যানারে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর একদল লোক পাঠ্যবইয়ে আদিবাসী শব্দের গ্রাফিতি পুনর্বহালের দাবিতে এনসিটিবি’র সামনে বিক্ষোভ করতে যায়। এতে দু’পক্ষের মধ্যে মারামারির হাতাহাতির সৃষ্টি হয়। এতে কয়েকজন আহত হন।
গতকাল একটি মিডিয়ায় এ নিয়ে কিছু মন্তব্য করেছেন মঙ্গল চাকমা নামে জনৈক ব্যক্তি। তিনি বলেছেন, শান্তিপূর্ণ সভা সমাবেশে এ ধরণের ন্যাক্কারজনক হামলা জুলাই-আগস্টের গণ অভ্যুত্থানের প্রতি অবমাননা ও তাদের স্বপ্ন মুক্ত বাংলাদেশের ওপর আঘাতের শামিল। তিনি আরো বলেন, বিভিন্ন সূত্র থেকে আমরা নিশ্চিত হয়েছি, সাড়ে ৪ মাস আগে ‘স্টুডেন্টস ফর সভরেন্টি’ নামে যে সংগঠনটির আত্মপ্রকাশ ঘটেছে, তাদের অনেক সদস্যই পার্বত্য চট্টগ্রামের সেটেলার বাঙালি পরিবারের সন্তান, এদের পেছনে রয়েছে মৌলবাদী গোষ্ঠির সমর্থন। নাগরিক সমাজকে এই ঘটনাটি গভীরভাবে ভাবতে হবে। গোড়াতেই জাতীয় পর্যায়ে এ ধরণের উগ্র জাতীয়তাবাদী ও সাম্প্রদায়িক উত্থানকে গুঁড়িয়ে দিতে না পারলে দেশের গণতান্ত্রিক বিকাশের ওপর ও প্রচ্ছন্ন কালো ছায়া ফেলবে এটা বলাই বাহুল্য। তিনি আরো বলেন, এর আগে গত ১২ জানুয়ারি ‘স্টুডেন্টস ফর সভরেন্টি’ পাঠ্যপুস্তকের প্রচ্ছদ থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দযুক্ত গ্রাফিতি বাতিলের দাবিতে এনসিটিবি ভবন ঘেরাও করেছিলো। তাদের ঘেরাওয়ে রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও পক্ষগুলোর সঙ্গে কোনরূপ আলাপ না করেই এনসিটিবি ওই দিন রাতেই পাঠ্যপুস্তকের অনলাইন ভাসন থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দটি বাদ দেয়। মঙ্গল চাকমা, পাঠ্যপুস্তক থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দটি বাদ দেয়ার জন্য তার কথিত মৌলবাদী গোষ্ঠির কর্মকান্ডকে দায়ী করেছেন। কিন্তু ভুলে গেছেন বিষয়টি বহু আগেই সরকারি পর্যায়ে মীমাংসিত। বাংলাদেশে কোন আদিবাসী নেই এবং পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অংশে বসবাসকারী বাংলাভাষী বাঙালি নয় এমন জনগোষ্ঠি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি। সবাই মিলে বাংলাদেশে। স্থায়ীভাবে বসবাসকারী সকল মানুষ বাংলাদেশী। তাদের জাতীয়তা বাংলাদেশী। শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে বাংলাদেশে বসবাসকারী বাংলাভাষী শংকর জাতিসত্তাই হলো এদেশের মূল আদিবাসী বা ভূমিপুত্র। অপরদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠির মানুষ ১৬ শতকে মিয়ানমার এবং কম্বোডিয়া থেকে পাশর্^বর্তী মনিপুরসহ বিভিন্ন দেশে থেকে। অথচ বাংলাদেশের মানুষের ইতিহাস ও সংস্কৃতি ৪ হাজার বছরের পুরোনো।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের প্রতœতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, কাউকে আদিবাসী বললে বাকীরা কী? বহিরাগত? ব্রিটিশ আমল বা আদিকাল থেকেই পাহাড়ি অঞ্চলে বাঙালিদের বসবাস ছিলো উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন যে, আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিলে তখন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির মানুষদের একটি নৈতিক জায়গা তৈরি হবে যে আমরা আদিবাসী, এই ভূমি আমাদের, তোমরা এখান থেকে সরে যাও। তাছাড়া সেখানে (পার্বত্য চট্টগ্রামে) স্বাধীনতার জন্য বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
বাংলাদেশ সরকার মনে করে সীমান্ত এলাকা হওয়ায় নিরাপত্তার দৃষ্টিভঙ্গীতে পার্বত্য চট্টগ্রাম অত্যন্ত স্পর্শকাতর। এই এলাকায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ব্যাপক তৎপরতাও আছে। তিনি মনে করেন, এই সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারের উচিত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির মানুষদের সাথে আলাপ আলোচনা করতে বসা যে ওই স্বীকৃতির মধ্যে দিয়ে তারা আসলে কী চায়। তবে শব্দের মধ্য দিয়ে কাউকে গোত্রভুক্ত করার প্রয়োজন নেই জানিয়ে তিনি বলেন, বরং তাদের বৈধ অধিকার থাকলে সেটা যেনো তাদেরকে দেয়া হয়। যেমন, তাদের ভূমির অধিকার যেনো সংরক্ষণ করা হয়। সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষাও সরকারের দায়িত্ব। তাদের শিক্ষা, বাসস্থান, কর্মসংস্থান, আর্থিক উন্নতি এগুলোর দিকে রাষ্ট্রের গুরুত্ব দেয়া দরকার।
সর্বোপরি, সচেতন মহল মনে করেন, কেউ নিজেদের আদিবাসী বলে দাবি করলেই তার দাবি মেনে নিতে হবে, এটা অযৌক্তিক। সকল দিক বিবেচনা এবং অনুসন্ধান ও গবেষণা শেষে বিগত সরকারের সময়ে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকায় বিদেশী কূটনীতিকদের আহবান জানিয়ে ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠির জনগণকে যাতে ‘আদিবাসী’ বলা না হয়। তিনি পরিস্কার জানিয়ে দেন যে, বাঙালিরাই এখানকার আদিবাসী। তখন তিনি গণ মাধ্যমের সম্পদকদেরও ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার না করার জন্য অনুরোধ করেন। সচেতন মহল মনে করেন, বাংলাদেশে আদিবাসী নেই এবং জাতিসংঘও এদেশের পার্বত্য বা সমতল ভূমিতে বসবাসকারীকে বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির লোকজন আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। বাংলাদেশ যদি কাগজে কলমে তাদেরকে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, তাহলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব দীর্ঘ মেয়াদে সংকটময় পরিস্থিতির মাঝে পড়তে পারে।