‘মানুষ তো মাছ নয়’
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:৩০:৫৬ অপরাহ্ন
কবি দিলওয়ারের ছড়ার ছন্দে লেখা সহ¯্রাধিক পংক্তির একটি কবিতার ৪টি পংক্তি হচ্ছেঃ ‘বড়ো মাছ ছোট মাছ ধরে খায়/জানি ঠিক/মানুষতো মাছ নয়/কি করে তা মানি ঠিক। ‘সেই দেশ কোন্ দেশ’ শীর্ষক এই কবিতার উপরোক্ত স্তবকে ছোটদের ওপর বড়োদের অন্যায়-অনাচার তথা মাৎস্যন্যায় নীতির বিষয়টি ফুটে ওঠেছে। ছোট-বড়ো বলতে মানুষ কিংবা দেশ অথবা গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠান হতে পারে। প্রকৃতির রাজ্যে পশুপক্ষী ও মাছের মধ্যে এই জংলী নীতি দেখা যায়। বড়ো মাছ ছোট মাছ, বড়ো হিং¯্র শিকারী পাখি ছোট ছোট পাখি, বাঘ ও সিংহ নিরীহ হরিণ জাতীয় প্রাণিকে হত্যা করে এগুলোর মাংস ভক্ষণ করে। অনেকটা জোর যার মুল্লুক তার নীতির মতো। কিন্তু সভ্য ও যুক্তি-মানবতা-মনুষত্বের অধিকারী মানুষ কিংবা তার অধীন দেশ, সরকার বা কোন প্রতিষ্ঠান যদি শুধু গায়ের জোরে কোন দুর্বল প্রতিপক্ষকে হত্যা, পদানত, পরাভূত কিংবা শোষণ করে, তবে তা কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না।
দুর্ভাগ্যের বিষয়, বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ ভারতের মাঝে এমনি মাৎস্যন্যায় বা গায়ের জোরে তুলনামূলক ক্ষুদ্র দেশ ও জনগোষ্ঠীকে পদানত ও শোষণের নীতির চর্চা বা অনুশীলন লক্ষ্য করা যায়। ইশারায় ইংগিতে মানবতাবাদী কবি দিলওয়ার এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গী ও আচরণের প্রতি তার নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছেন, প্রতিবাদ করেছেন। ভারত তার সকল ক্ষুদ্র প্রতিবেশী দেশের প্রতি এমন দৃষ্টিভঙ্গী পোষণ করে আসছে দীর্ঘকাল যাবৎ। ফলে তার সকল প্রতিবেশী দেশই ভারতকে অপছন্দ ও ঘৃণা করে। এড়িয়ে চলে। এটা মালদ্বীপ, শ্রীলংকা থেকে নেপাল, বাংলাদেশ পর্যন্ত বিষয়টি বিস্তৃত ও সত্য। বিগত বছরগুলোতে ভারত বাংলাদেশের সাথে যে অন্যায় ও বৈষম্যমূলক আচরণ করেছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে উভয় দেশের যৌথ আন্তর্জাতিক নদীর পানি বন্টন নিয়ে চরম বৈষম্যমূলক এবং অমানবিক আচরণ। এক্ষেত্রে তিস্তার পানি নিয়ে বিগত বছরগুলোতে ভারত যে অন্যায় ও অবিচার করেছে, তা ফোরাত নদীর তীরের ঐতিহাসিক কারবালার ঘটনার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।
বাংলাদেশের তিস্তা পাড়ের কোটি মানুষকে বঞ্চিত করে ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গ তিস্তার পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহার করে নিচ্ছে বছরের পর বছর ধরে। আর পানির অভাবে বাংলাদেশের তিস্তা পাড়ের মানুষ হাহাকার করছে। পানির অভাবে তাদের ক্ষেতের জমি মরুতে পরিণত হয়েছে। জেলেরা বঞ্চিত হচ্ছে মাছ থেকে, কৃষকরা পারছে না তাদের জমিতে ফসল উৎপাদন করতে। এভাবে আন্তর্জাতিক নদীর পানি কোন সংলগ্ন বা সংশ্লিষ্ট দেশ কর্তৃক একতরফাভাবে প্রত্যাহার আন্তর্জাতিক আইনের লংঘন। কিন্তু বাংলাদেশের হাজারো প্রতিবাদ সত্বেও ভারত তা করে চলেছে। শুধু পানি প্রত্যাহার করেই ক্ষান্ত হয়নি ভারত, বাংলাদেশ যখন তার তিস্তা তীরবর্তী মানুষকে শুষ্ক মৌসুমে পানি শূন্যতা ও বর্ষা মৌসুমে বন্যা থেকে বাঁচাতে তিস্তা বাঁধসহ একটি নদী ব্যবস্থাপনা স্কীম বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে, তখনই নিরাপত্তাসহ নানা অজুহাত দেখিয়ে এ ধরনের মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাগড়া দিচ্ছে। এ নিয়ে স্বৈরাচারী ভারত তোষণকারী শেখ হাসিনার আমলে যে তেলেসমাতি ও ভেলকিবাজী করেছে ভারত তা যে কোন সচেতন মানুষের মনে থাকার কথা।
গতকাল মিডিয়ায় ‘টেনশনে ভারত, তিস্তা প্রকল্প করবে চীন!’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ভারতের পানি আগ্রাসনের বিষয়ে উত্তরাঞ্চলের মরুকরণ ঠেকাতে চীন বন্ধুর মতো বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিলো। তিস্তা প্রকল্পে চীন সহায়তা করতে চেয়েছিলো কিন্তু বাধ সাধে ভারত। যে ভারতের কারণে দুর্গতি সেই ভারতকে তিস্তা প্রকল্প করার কাজ দিতে উদ্যোগ নেয় ভারতের সেবাদাসীতূল্য শেখ হাসিনা। এতে বিস্মিত হয় চীন।
এ নিয়ে টানাপোড়েনও সৃষ্টি হয়। তখন হাসিনা বেইজিং সফরে গেলে একদিন আগেই তাকে সফর সমাপ্ত করে ফিরে আসতে হয়। এছাড়া বাজেট সহায়তার জন্য প্রার্থিত বিলিয়ন ডলারের পরিবর্তে কয়েক শত ডলার দিয়ে হাসিনাকে বিদায় করে দেয়। এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চীনকে প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অন্তত: পরিস্থিতি বিবেচনায় এমনটি মনে করছেন সচেতন মহল। প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয় সাপেক্ষ এই তিস্তা পরিকল্পনার প্রস্তাব প্রথম দিয়েছিলো চীন। এখন যদি তারা তা বাস্তবায়ন করে তবে তিস্তা পারের ২ কোটি মানুষের জীবন বদলে যাবে। অনেকখানি বদলে যাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা। এদেশের ভুক্তভোগী মানুষ তাই এই শুভ উদ্যোগের দিকে তাকিয়ে আছে। আর তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে পানি নিয়ে ভারতের মাৎস্যন্যায় নীতি অর্থাৎ আগ্রাসী তৎপরতার হাত থেকে এদেশের কোটি মানুষ বেঁচে যাবে এতে কোন সন্দেহ নেই।