ল’ কলেজের অধ্যক্ষের জালিয়াতি!
প্রকাশিত হয়েছে : ৩১ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:৩৫:৫৬ অপরাহ্ন
গতকাল মিডিয়ায় এক চাঞ্চল্যকর সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ‘৩০ বছর পর জানা গেলো আইন কলেজের অধ্যক্ষের সনদ ভুয়া’ শিরোনামে প্রকাশিত এই সংবাদে বলা হয়েছে, ৩০ বছর পর জানা গেলো কুমিল্লা বঙ্গবন্ধু ল’ কলেজের অধ্যক্ষের এলএলবি পাসের সনদটি জাল। এই অধ্যক্ষের নাম সরদার মোঃ আলী আজাদ। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বঙ্গবন্ধু ল’ কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোঃ ইলিয়াছ। এ নিয়ে কুমিল্লা আদালত পাড়ায় সৃষ্টি হয়েছে তীব্র প্রতিক্রিয়া। কুমিল্লার জনৈক সিনিয়র আইনজীবী বলেন, এটি অত্যন্ত লজ্জার বিষয়। এই সরকার মোঃ আলী আজাদ ৪৪ বছর আইনজীবী ছিলেন। ছিলেন অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর। ৩০ বছর ধরে অধ্যক্ষ। অধ্যক্ষ প্রতারণা করলে ছাত্ররা শিখবে কী? তা-ও আইনজীবী তৈরীর কলেজে।
বঙ্গবন্ধু ল’ কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোঃ ইলিয়াছ জানান, সরদার মোঃ আলী আজাদের দুর্নীতির বিষয়ে গঠিত কমিটি কাগজপত্র খুঁজতে গিয়ে দেখেন, তার ১৯৬৮ সালের সনদে লেখা ‘কুমিল্লা, বাংলাদেশ’। তখন তো বাংলাদেশ হয়নি। তার ডিগ্রির সনদেও একই অবস্থা। এরপর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে খোঁজ নিয়ে দেখা যায় সনদটি জাল। তার আইনজীবী সনদ বাতিলের জন্য বার বার কাউন্সিলে আবেদন করা হবে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক সরদার মোঃ আলী আজাদের সনদটি জাল।
বলা বাহুল্য, স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট জালের ঘটনা যে একেবারেই ঘটেনি, এমন নয়। তবে অতীতে এ ধরনের ঘটনা ছিলো বিরল। আর সরদার আলী আজাদের জালিয়াতির ঘটনা সেই বিরল ঘটনাগুলোর একটি। স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার গত ১৫ বছরের শাসনামলে এ ধরনের জালিয়াতির হাজার হাজার ঘটনা ঘটেছে, যা অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। বিশেষভাবে মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের সন্তান ও নাতিপুতিদের জাল সনদ দিয়ে সরকারে নিম্ন পর্যায় থেকে উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত চাকরী গ্রহণের বিষয়টি এখন প্রশাসন এমনকি দেশব্যাপী সমালোচিত হচ্ছে। এছাড়া ভুয়া বা জাল শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ দিয়ে চাকরী বাগিয়ে নেয়ার ঘটনাও কম নয়। এর সাথে আছে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে পরীক্ষা পাশ ও চাকরী পাওয়ার বিষয়টি। চলতি বছরের ৪ অক্টোবর বিভিন্ন জাতীয় মিডিয়ায় প্রকাশিত সংবাদের শিরোনাম হচ্ছেঃ ‘জাল সনদে চাকরী করা ৬৭৭ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ’, ‘জাল সনদে চাকরী করছেন ১১৫৬ শিক্ষক’, ‘জাল সনদে সাবরেজিস্ট্রারের চাকরী করলেন রামজীবন’, ‘জাল সনদে চাকরী, ‘সেই ২০ শিক্ষকের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা’, ‘জাল সনদে চাকরী হারাচ্ছেন ৭ কলেজের ১৯ শিক্ষক’। উপরের সংবাদ শিরোনামগুলো থেকে কারো বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় বিগত বছরগুলোতে চাকরী পাওয়ার ক্ষেত্রে ধরনের অনিয়ম, জালিয়াতি ও দুর্নীতি হয়েছে।
বলা বাহুল্য, এভাবে জাল সনদে চাকরী পাওয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্র্তৃপক্ষের লোকজনও যে জড়িত ছিলেন, এতে কোন সন্দেহ নেই। কারণ চাকরী প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ তথা কর্মকর্তাদের দায়িত্ব হচ্ছে, প্রার্থীদের সনদের সত্যতা যাচাই করা। কিন্তু তারা তা করেননি। ধারণা করা হয়, ঘুষ দুর্নীতির কারণে সনদ পরীক্ষা বা যাচাইয়ের কাজটি করতে দেয়া হয়নি বা করা হয়নি। গত ১৫ বছরে এই জালিয়াতির বিষয়টি ওপেন সিক্রেট এমনকি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে ক্ষমতাসীন দুর্নীতিবাজ আমলা কর্মকর্তারা এভাবে নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে কোটি কোটি হাতিয়ে নিয়েছে। পিয়নের চাকরী থেকে বিসিএস ক্যাডারের চাকরীক্ষেত্রে এমন অগণিত ঘটনার অভিযোগ রয়েছে।
দেখা গেছে, যে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা অর্থের বিনিময়ে বা স্বজনপ্রীতির কারণে জাল সার্টিফিকেটধারী প্রার্থীকে চাকরী দিয়েছে, সেও এর আগে একই কায়দায় চাকরী পেয়েছে। এভাবে গোটা প্রশাসন জুড়ে গড়ে ওঠেছিলো জালিয়াতি ও দুর্নীতির বিশাল নেটওয়ার্ক। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর এগুলো ক্রমশঃ প্রকাশিত হচ্ছে। উপরোক্ত ল’ কলেজের অধ্যক্ষ আলী আজাদের দুর্নীতির তদন্ত করতে গিয়ে কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি না করলে তার এই মহাজালিয়াতি চিরদিন চাপা পড়ে থাকতো। এ ধরনের সনদ জালিয়াতি বিগত বছরগুলোতে দেশকে মেধাশূন্যতার দিকে পরিচালিত করেছে। এর বদলে উপহার দিয়েছে একটি অথর্ব প্রশাসন ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা, যা রীতিমতো আত্মঘাতী ও গোটা জাতির জন্য ধ্বংসাত্মক। জনগণ এ অবস্থা থেকে উত্তরণ চায়, চায় দুর্নীতিমুক্ত একটি মেধাবী জাতিসত্তা।