সাংবাদিকতার নামে মাফিয়া বৃত্তি!
প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:৩০:৫০ অপরাহ্ন
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, দেশের ২৪ সাংবাদিকের ব্যাংক হিসাবে এক হাজার ২৬৮ কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে এক হাজার ২৩৮ কোটি টাকা তুলে নেয়া হয়েছে। ব্যাংক হিসাবগুলোতে বর্তমানে ৩০ কোটি টাকা জমা রয়েছে। এসব সাংবাদিকের মধ্যে দৈনিক ভোরের কাগজের সম্পাদক ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক কারাবন্দী শ্যামল দত্তের ২৩টি ব্যাংক হিসাবে এক হাজার ৪২ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৫৮ কোটি টাকা লেনদেন হয় দৈনিক কালবেলার সম্পাদক ও প্রকাশক সন্তোষ শর্মার ব্যাংক হিসাবে।
এ প্রসঙ্গে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এই আয় অবশ্যই অস্বাভাবিক, বৈধ আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। গত ১৫ বছরে অন্য অনেক পেশার মতো সাংবাদিকতা পেশাও কর্তৃত্ববাদের দোসর হয়ে কাজ করেছে। রাষ্ট্র ও জনগণের হয়ে কাজ না করার কারণে পেশাগত দেউলিয়ায় পরিণত হয়েছে। অনৈথিক প্রমাণ সাপেক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। একই সঙ্গে সব পেশা দলীয়করণ বন্ধ করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ এ ধরণের কাজ করার সাহস না পায়।
জানা গেছে, গত বছরের ২২ অক্টোবর ২৮ সাংবাদিকের ব্যাংক হিসাবের তথ্য আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিটের কাছে (বিএফএইচইউ) চেয়ে চিঠি দিয়েছিলো তথ্য মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি বিএফআইইউ থেকে তথ্য মন্ত্রণালয়কে তাদের মধ্যে ২৪ জনের ব্যাংক হিসাবের তথ্য প্রদান করা হয়। তাদের বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনকেও চিঠি দেয়া হয়েছে। বিগত সরকারের আমলে তথ্য মন্ত্রণালয় এসব সাংবাদিকের ব্যাংক হিসাবের তথ্য চেয়ে চিঠি দিয়েছিলো তাদের দায়িত্বের অংশ হিসেবে। কিন্তু স্বৈরাচারী সরকার যদি ক্ষমতায় থাকতো, তবে ক্ষমতার শীর্ষ মহলের হস্তক্ষেপে এরা যে শেষ পর্যন্ত নির্দোষ প্রমাণিত হতো, এতে কোন সন্দেহ। দুদকের তদন্তে দেখা যেতো তাদের ব্যাংক একাউন্টে জ্ঞাত আয় বহির্ভুত কোন অর্থ কড়ি পাওয়া যায়নি। এভাবে এব অসৎ সাংবাদিক সৎ সাংবাদিক হিসেবে দুদকের সার্টিফিকেট পেয়ে যেতো। এ ধরণের ঘটনা স্বৈরাচারী হাসিনা ও তার সরকারের ঘনিষ্ট বহু আমলা ও ব্যবসায়ী এবং অন্যান্য পেশার ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ঘটতে দেখা গেছে। এভাবে দুদককে ব্যবহার করা হয়েছে অসৎকে সৎ বানানো হাতিয়ার বা রাবার স্ট্যাম্প হিসেবে।
জানা গেছে, বর্ণিত সাংবাদিকেরা দেশের মিডিয়া জগতকে সম্পূর্ণ কুক্ষীগত করে রেখেছিলো। ক্ষমতার শীর্ষ মহলের নির্দেশ অনুসারে তারা স্বৈরাশাসক হাসিনাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার জন্য তার গুণকীর্তন ও উন্নয়নের কথা নিজেদের মিডিয়ায় প্রচার করতো এবং অন্যান্য মিডিয়ায় প্রকাশ ও প্রচারের ব্যবস্থা করতো এই অসৎ সাংবাদিকের নির্দেশ ও পরামর্শের বাইরে গিয়ে নিয়ে কোন মিডিয়া বা সাংবাদিকের পক্ষে সরকারের স্বার্থবিরোধী কিছু প্রচার-প্রকাশ করা অসম্ভব ব্যাপার ছিলো। যদি কেউ এমন দুঃসাহস দেখাতো তবে তার পেশাগত জীবন হুমকির সম্মুখিন হতো। বাতিল হতো মিডিয়ার লাইসেন্স, চাকুরী যেতো সাংবাদিক ও সংবাদ কর্মীর। এমন প্রাণও যেতো বেশি বাড়াবাড়ি করলে কিংবা অতিরিক্ত সাহসী হলে। এমনই ঘটনার জেরে নির্মমভাবে প্রাণ হারাতে হয়েছিলো সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনীকে।
বলা বাহুল্য, এসব সিন্ডিকেট সাংবাদিক-সম্পাদক ও মিডিয়া মালিক সরকারী বিজ্ঞাপনের সিংহভাগই পেতো। তাদের পরামর্শ ও অনুমোদন ছাড়া কোন মিডিয়ার পক্ষে সরকারী বিজ্ঞাপন পাওয়া প্রায় অসম্ভব ছিলো। এভাবে দেড় দশকে তারা হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সরকারি বিভিন্ন বিভাগ, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন বাবদ। আর এজন্যই তাদের ব্যাংক হিসাবে হাজারো কোটি টাকা লেনদেন হতে দেখা গেছে। এভাবে সাংবাদিকের নীতি নৈতিকতা ও বিবেক বিসর্জন দিয়ে তারা গত দেড় দশক স্বৈরাচার হাসিনার সরকার ও তার প্রভু আধিপত্যবাদী ভারতের স্বার্থে কাজ করেছে। নামে সাংবাদিক ও সম্পাদক হলেও তারা ছিলো ¯্রফে সরকারের দালাল এবং ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র’এর এজেন্ট। বিগত দেড় দশকে এসব মিডিয়ায় প্রচারিত ও প্রকাশিত নিউজ, প্রতিবেদন ও কলামগুলো দেখলে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। এগুলোতে জনগণের দুর্ভোগের কথা খুব অল্পই পাওয়া যাবে। সরকারের উন্নয়নের মিথ্যা গালগল্প এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সমালোচনা ও নিন্দাবাদই ছিলো এসব নিউজ ও লেখার আশি/নব্বই ভাগ জুড়ে। এভাবে সাংবাদিক নামধারী এসব মাফিয়া গোষ্ঠীর সহায়তায় স্বৈরশাসক কর্তৃত্ববাদী শেখ হাসিনা ও তার দোসররা দেশের অকাতরে সম্পদ লুটপাট পাচার ও দেশকে গণতন্ত্রহীন খুন ও গুমের রাজত্বে পরিণত করে। বিশে^র অন্যত্র অর্থাৎ গাজায় যখন ফিলিস্তিনী সাংবাদিকেরা মাতৃভূমির জন্য জীবন বিলিয়ে দিয়েছে, তখন বাংলাদেশের এসব সাংবাদিক স্বদেশকে স্বৈরশাসন ও পরাধীনতা নিগড়ে বন্দী করার ও রাখার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে নিজের ক্ষুদ্র ব্যাক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করার লক্ষ্যে।