কারসাজি ও কালোবাজারি ক্ষেতেও বিস্তৃত
প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:৩০:৪০ অপরাহ্ন
মজুতদারি, সিন্ডিকেটিং, কালোবাজারি ও কারসাজি যেনো এদেশের সাধারণ মানুষের ভাগ্যলিপি হয়ে দেখা দিয়েছে। এগুলোর মারপ্যাঁচ ও খপ্পরে পড়ে সাধারণ মানুষ প্রতারিত ও বঞ্চিত হচ্ছেন প্রতিনিয়ত, প্রতিদিন। এবার হিমাগারে আলু রাখতে গিয়েও আলু চাষীরা পড়েছেন কালোবাজারি কারসাজিকারকদের খপ্পরে। কৃষকদের অভিযোগ, হিমাগার কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে মজুতকারীরা আলু সংরক্ষণের স্লিপ আগেভাগেই হাতিয়ে নিচ্ছে। ফলে সাধারণ আলু চাষীরা বঞ্চিত হচ্ছেন। ঘটনাটি ঠাকুরগাঁও জেলার। জানা গেছে, গত মৌসুমে আলুর ভালো দাম পেয়েছেন ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার কৃষকেরা। এতেই এবার আরো বেশী জমিতে আলু আবাদ করেন অনেকে। কয়েক দিনের মধ্যেই সেই আলু তোলার উপযোগী হবে। কিন্তু বাজারে এখন দাম কম থাকায় ক্ষেতের আলু হিমাগারে সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অনেকে। তাই আগাম স্লিপের আশায় একের পর এক হিমাগারে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু কোথাও স্লিপ পাচ্ছেন না। উপায়ান্তর না দেখে আলু সংরক্ষণের হাল ছেড়ে দিয়েছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ঠাকুরগাঁও কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে উক্ত জেলায় ২৭ হাজার ৫শ হেক্টর জমিতে আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। কিন্তু আবাদ হয়েছে ৩৪ হাজার ৭২৫ হেক্টরের বেশী জমিতে। আর এ থেকে পাওয়া যাবে ৮ লাখ ৬৮ হাজার ১২৫ টন আলু। অন্যদিকে আলু সংরক্ষণের জন্য জেলায় ১৭টি হিমাগার রয়েছে। এসব হিমাগারের ১ লাখ ৪৫ হাজার ৫৩২ টন আলু সংরক্ষণ করা যায়। ফলে চাষীদের উৎপাদিত অধিকাংশ আলুই থেকে যাচ্ছে সংরক্ষণের বাইরে। সংরক্ষণের সুযোগ না পেয়ে কৃষকদের তাদের ক্ষেতের আলু বাজারে বিক্রি করে দিতে হচ্ছে। আর এতে বাজারে আলুর দাম আরো কমে গেলে আলু চাষীরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশংকা। হিমাগারে আলু রাখার দুই ধরনের বুকিং পদ্ধতি রয়েছে, ‘লুজ বুকিং’ ও ‘পেইড বুকিং’। লুজ বুকিং হলো আলু বিক্রি করে হিমাগারের মালিককে ভাড়া শোধ করতে হবে। এবার লুজ বুকিংয়ের রেট হচ্ছে ৫০ কেজি ওজনের এক বস্তা আলুর জন্য ৪০০ টাকা অর্থাৎ প্রতি কেজি আলুর জন্য ৮ টাকা। তবে জেলার কোন হিমাগারই লুজ বুকিং নেয় না। আলু সংরক্ষণ করতে হিমাগার কর্তৃপক্ষ আগাম স্লিপ বিতরণ করে পেইড বুকিংয়ের ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে এসব স্লিপ নিতে প্রতি বস্তা আলুর বিপরীতে কৃষকদের ৫০ থেকে ১০০ টাকা আগাম গুণতে হচ্ছে।
কৃষকদের অভিযোগ, প্রকৃত কৃষকেরা আলু সংরক্ষণের স্লিপ সংগ্রহ করতে পারেননি। আর এতে কৃষকেরা তাদের উৎপাদিত আলু ক্ষেত থেকে তোলার সঙ্গে সঙ্গে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হবেন। তারা আগামী মৌসুমের জন্য বীজ আলুও সংরক্ষণ করতে পারবেন না। তাদের অভিযোগ, হিমাগার কর্তৃপক্ষ প্রকৃত চাষীদের নয়, কেবল মজুতদার ও ব্যবসায়ীদের কাছে আলু রাখার স্লিপ বিক্রি করেছে। ফলে এলাকার চাষীরা হিমাগারে আলু রাখার সুযোগ পাচ্ছেন না।
উপরোক্ত ঘটনাটি কৃষি প্রধান ও কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত বেদনার, অত্যন্ত দুঃখের। কৃষক ফসল উৎপাদন করে উপযুক্ত দাম পায় না, সংরক্ষণের সুযোগ পায় না। কৃষিখাতের জন্য এর চেয়ে দুঃসংবাদ আর কী হতে পারে, এমন প্রশ্ন সচেতন মহলের।
দীর্ঘদিন যাবৎ এেেদশর কৃষক উৎপাদনকারীরা তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের দাবি জানিয়ে আসছেন। প্রতিটি সরকারের সময় এ ব্যাপারে আশ^াস দেয়া হলেও কার্যত: কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি এ পর্যন্ত। ফলে প্রতি বছর প্রচুর কৃষিপণ্য নষ্ট হচ্ছে। অথচ এসব কৃষিপণ্য যথাযথভাবে সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়ামত করা হলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানি করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব হতো।
প্রায় এক দশক আগে মিডিয়ায় ‘কৃষিপণ্যের সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ জরুরি’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, আগামী দিনের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দরকার কৃষি সংশ্লিষ্ট কর্মকান্ডের আধুনিকায়ন। উৎপাদন বাড়ানো, কৃষি জমি বা চাষযোগ্য জমি সংরক্ষণের পাশাপাশি উৎপাদিত খাদ্যের যথাযথ সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সরবরাহের বিষয়েও যথেষ্ট নজর দিতে হবে। এ নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হচ্ছে দীর্ঘকাল ধরে কিন্তু সরকারের শীর্ষ মহলকে এ ব্যাপারে এ পর্যন্ত তেমন কোন উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি।
বিগত কয়েক দশকে এদেশে শত শত মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেও সরকারী উদ্যোগে সংরক্ষণাগার, কিংবা প্রক্রিয়াজাতকরণের তেমন কোন শিল্প কারখানা গড়ে ওঠেনি। বিষয়টি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। আমরা এদিকে নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি ও মনোযোগ আকর্ষণ করছি।