শিশু ধর্ষণ : একটি জাতীয় সংকট ও আমাদের দায়িত্ব
প্রকাশিত হয়েছে : ১১ মার্চ ২০২৫, ৯:১৫:৫৪ অপরাহ্ন
মারুফ হাসান ::
সম্প্রতি বাংলাদেশ জুড়ে শিশু ধর্ষণের ঘটনার ক্রমবর্ধমান হার আমাদের সমাজকে গভীর সংকটে ফেলে দিয়েছে। বিশেষ করে মাগুড়ার শিশু আছিয়া’র বিষয়টি পুরো বাংলাদেশকে একটি ধাক্কা দিয়েছে। এরকম একের পর এক নৃশংস ঘটনা আমাদের বিবেককে নাড়া দিচ্ছে, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে-এই অপরাধ থেমে নেই বরং বাড়ছে। শিশুদের প্রতি এমন অমানবিক নির্যাতন কোনো সভ্য সমাজের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না।
ধর্ষণ, বিশেষ করে শিশু ধর্ষণ, কেবল শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন নয়, এটি মানবতার চরম অবমাননা। একটি শিশু তার শৈশব হারানোর পাশাপাশি আজীবন এক গভীর মানসিক ক্ষতের শিকার হয়। সমাজ, পরিবার এবং রাষ্ট্রের কাছে এটি এক অশ্রুত আর্তনাদ যা অবিলম্বে আমাদের সক্রিয় দায়িত্ব গ্রহণের দাবি জানায়।
পরিসংখ্যান ও তথ্য বলছে, ২০২১ সালে ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ (এমজেএফ) এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এই বছরে ৮১৮ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে, যা ২০২০ সালের ৬২৬টি ঘটনার তুলনায় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি। এছাড়া, ২০২১ সালে ৪৩,০৫৪টি বাল্যবিয়ের ঘটনা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে, যা পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় আশঙ্কাজনকভাবে বেশি। ২০২২ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, এই মাসে ২৭৩ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে, যার মধ্যে ১৩৫টি শিশু। ২০২২ সালের প্রথম আট মাসে জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এই সময়ে ৫৭৪ জন কন্যাশিশু যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে, যার মধ্যে ৮৪ জন দলবদ্ধভাবে ধর্ষণের শিকার হয়েছে।
বিভিন্ন গবেষণা বলছে, বিচারহীনতা, নৈতিক অবক্ষয়, সাইবার অপরাধ, পর্নোগ্রাফির সহজলভ্যতা এবং সামাজিক সচেতনতার অভাব এই অপরাধ বৃদ্ধির মূল কারণ। অনেক ক্ষেত্রেই প্রভাবশালী অপরাধীরা শাস্তি এড়িয়ে যায়, ফলে অপরাধ প্রবণতা আরও বেড়ে যায়। এছাড়াও, ভিকটিম ব্লেমিং এবং সামাজিক লজ্জার ভয়ে অনেক পরিবার আইনের আশ্রয় নিতে ভয় পায়।
বাংলাদেশে ধর্ষণের বিরুদ্ধে কঠোর আইন থাকলেও কার্যকর বাস্তবায়নের অভাবে অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। দ্রুত বিচার, কঠোর শাস্তি এবং অপরাধীদের রাজনৈতিক ও সামাজিক আশ্রয়-প্রশ্রয় বন্ধ করতে হবে। প্রয়োজনে ধর্ষণের শাস্তি আরও কঠোর করে জনসম্মুখে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
শুধু আইনি ব্যবস্থার মাধ্যমে ধর্ষণ নির্মূল সম্ভব নয়, আমাদের সামাজিক মূল্যবোধের পরিবর্তনও জরুরি। শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে, শিশুদের সাথে খোলামেলা আলোচনা করতে হবে এবং তাদের আত্মরক্ষা ও সঠিক-ভুলের ধারণা দিতে হবে।
গণমাধ্যমের উচিত এই অপরাধের খবর প্রকাশ করার সময় ভিকটিমের পরিচয় গোপন রাখা এবং অপরাধীদের মুখোশ উন্মোচন করা। পাশাপাশি, এই সমস্যা মোকাবিলায় জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য আরও কার্যকরী প্রতিবেদন ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা প্রয়োজন।
এই সামাজিক ব্যাধির বিরুদ্ধে আমাদের সবাইকে সম্মিলিতভাবে রুখে দাঁড়াতে হবে। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, প্রশাসন এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বিত উদ্যোগই পারে শিশু ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধকে নির্মূল করতে।
আমাদের মনে রাখতে হবে-আজ যে শিশু নির্যাতনের শিকার, আগামীকাল সে আমাদেরই সন্তান হতে পারে। তাই এখনই সময় সোচ্চার হওয়ার, প্রতিরোধ গড়ে তোলার এবং অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করার।