এতো ব্যর্থতা রাখবো কোথায়?
প্রকাশিত হয়েছে : ১০ মার্চ ২০২৩, ১২:১৫:১০ অপরাহ্ন
ঢাকার গুলিস্তানে বিস্ফোরণে নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৯ জনে। এতে আহত হয়েছেন দুই শতাধিক মানুষ। এখনো নিখোঁজ রয়েছেন কয়েকজন। এর মাত্র দু’দিন আগে ঢাকার সায়েন্স ল্যাবরেটরী এলাকায় একটি ভবনে বিস্ফোরণে ৩ জন নিহত আর অন্তত: ৩০ জন আহত হয়েছিলেন। গত মঙ্গলবার বিকেল পৌণে পাঁচটার দিকে গুলিস্তানের ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনাটি ঘটে। রাত ৯ টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক জানান, ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। বেজমেন্ট ও গ্রাউন্ড ফ্লোরটি অনেকটা ধসে গিয়েছে, কলামগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই তারা ঢুকতে পারছেন না।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় পর পর দু’টি বিস্ফোরণের ঘটনার পর অনেকের প্রশ্ন, রাজধানী ঢাকা নগরী আসলে কতোটা নিরাপদ আছে কিংবা নতুন পুরোনো মিলে যে হাজার হাজার অপরিকল্পিত ভবন গড়ে উঠেছে, সেগুলো এই নগরীকে অগ্নিগর্ভ হওয়ার মতো ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে কি-না।
সচেতন মহলের মতে, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির অসংখ্য অবৈধ লাইন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পুরো নগর জুড়ে, যার ফলে অনেক জায়গায় লিকেজ তৈরী হচ্ছে, যা থেকে হতে পারে মারাত্মক বিস্ফোরণ। এছাড়া নগরীর ভবনসমূহে অভ্যন্তরীন বৈদ্যুতিক সংযোগ লাইনগুলো নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পরিচর্যা করা হয় না। ফলে প্রায়ই শর্ট সার্কিট থেকে অগ্নিকান্ডের সূচনা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে রাস্তার পাশের ভবনগুলো পর্যাপ্ত জায়গা না রাখায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির লাইন, যা ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে পুরো ভবনকেই। আবার স্যুয়ারেজের লাইন ঠিক না থাকায় বা নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রম না করার কারণে গ্যাস জমে যাচ্ছে সেপটিক ট্যাংকে। এছাড়া গ্রীষ্মে এসি বিস্ফোরণ বেড়ে যাওয়ার কারণ হলো নিম্নমানের এসি ব্যবহার এবং গরমের সময় সার্ভিসিং না করিয়েই এসি ব্যবহার শুরু করা।
সবচেয়ে মারাত্মক ব্যাপার হচ্ছে, বহু ভবন নির্মাণ করা হয়েছে বা হচ্ছে বিল্ডিং কোড না মেনেই। পুরোনো ভবনগুলোর ভেতরে এক সঙ্গে অনেক এসি ব্যবহার করা হচ্ছে নির্ধারিত দূরত্ব না মেনেই, যেগুলোর কোন একটিতে গ্যাস লিকেজ হলে সবগুলোই বিস্ফোরিত হতে পারে। দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হচ্ছে ঢাকায় ঝুঁকিপূর্ণ ভবন কতোটা আছে তার কোন হিসাব কারো কাছে নেই। তবে ঢাকার আধুনিক এলাকাগুলোর অন্যতম বনানীতে একটি ভবনে আগুন লাগার পর ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করার কথা বলে রাজউক। পরে সংস্থাটি দাবি করে যে, ২ লাখের বেশী ভবন পর্যালোচনা করে তারা দেখেছেন ১ লাখ ৩৪ হাজারেরও বেশী ভবন যথাযথ নিয়ম মেনে তৈরী হয়েছে। ২০১৫ সালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় বলেছিলো যে, ঢাকায় ৭২ হাজারের মতো ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে। কিন্তু বুয়েটের অধ্যাপক মেহেদী আনসারী বলেন, এগুলো পূর্ণাঙ্গ জরীপ নয়। তাই ঢাকা নগরী প্রকৃত অবস্থা বলা মুশকিল। যাই হোক, এসব ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের ব্যাপারে পরে আর কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। এ প্রসঙ্গে রাজউকের স্পষ্ট বক্তব্য হচ্ছে, পুরো নগরীতে সমীক্ষা চালিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সব ভবনকে চিহ্নিত করার মতো জনবল তাদের নেই।
এতো গেলো একটি দেশের রাজধানীর প্রকৃত চিত্র, হালচাল। প্রশ্ন হচ্ছে, গুলিস্তানের ভবন বিস্ফোরণের পর উদ্ধারকারী কর্তৃপক্ষ কি যথাসময়ে তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে সক্ষম হয়েছে? অনেকের মতে, যদি উদ্ধার কার্য ঠিকমতো চালানো হতো তবে এতো মানুষের মৃত্যু এড়ানো যেতো। অনেকে আহত অবস্থায় ধ্বংসস্তূপের নীচে দীর্ঘক্ষণ চাপা পড়ে থাকায় এবং ক্ষতস্থান থেকে রক্তক্ষরণে মারা গেছেন। এখনো অনেকে নিখোঁজ রয়েছেন। যদি তাৎক্ষণিকভাবে আধুনিক ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে বা ধ্বংসস্তুপের নীচ থেকে চাপা পড়া মানুষগুলোকে উদ্ধার করা যেতো তবে অনেকের জীবনই হয়তো রক্ষা পেতো। আর অনেকের আহত অবস্থার অবনতিও ঘটতো না।
কিছুদিন আগে তুরস্কে এক ভয়াবহ ভূমিকম্পে এভাবে লাখ লাখ বাড়িঘর ধসে পড়ে। কঠিন হলেও তারা সেগুলো সামাল দিয়েছে। সফল উদ্ধারকার্য পরিচালনা করেছে তুর্কী সরকার। কিন্তু বাংলাদেশে যদি এর চেয়ে অনেক কম ভয়াবহ ভূমিকম্প হয় এবং কয়েকশ ভবন ধসে পড়ে তবে বর্তমান সক্ষমতা ও ক্ষমতা নিয়ে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো কীভাবে উদ্ধার অভিযানে সফল হবে, এমন প্রশ্ন এখন সংগতভাবেই সচেতন মানুষের মনে জাগছে। প্রশ্ন জাগছে, বাংলাদেশ যখন তার রাজধানীতে একটি মাত্র ভবন ধসের ঘটনায় সফল ও কার্যকরভাবে উদ্ধারকার্য পরিচালনায় ব্যর্থ, তখন ভবিষ্যতে একসঙ্গে অনেকগুলো ভবন ধসের মতো দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা যদি কখনো ঘটে, তবে কীভাবে তা সামাল দেয়া হবে। ক্ষমতাসীনরা তো দেশকে ‘উন্নয়নের রোল মডেল’ ও উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে ‘কিংবা’ সিঙ্গাপুর-কানাডা হয়ে গেছে’ বলে কথায় কথায় উল্লেখ করেন। যদি তা-ই হয়ে থাকে, তবে সামান্য একটি ভবন ধসে পড়ার ঘটনা সামাল দিতে এতো হিমশিম খাচ্ছেন কেনো কর্তৃপক্ষ? এতো অনিয়ম ও বিশৃংখলা কেনো ভবন নির্মাণসহ বিভিন্ন ইউটিলিটি লাইনগুলোতে? এসব প্রশ্নই এখন জাগছে দেশের সাধারণ মানুষের মাঝে।