জুলাই বিপ্লবী পরিবারের কর্মসংস্থানে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের ভূমিকা প্রসঙ্গ
প্রকাশিত হয়েছে : ০২ জানুয়ারি ২০২৫, ৭:২৪:১৬ অপরাহ্ন
মোস্তাফিজুর রহমান:
১৯৭৮ সালে তৎকালীন সরকার দেশের বেকার সমস্যা সমাধানের জন্য যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা করেন। সে মোতাবেক ১৯৭৯ সালে দেশে তিনটি যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে এবং পর্যায়ক্রমে সকল জেলায় বেকার যুবদের কর্মসংস্থানের জন্য হাঁস-মুরগী,গবাদি পশুপালন,মৎস্য চাষ ও কৃষি বিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে বাংলাদেশের বেকার সমস্যা সমাধানে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করাসহ কৃষি খাতের বাণিজ্যিক উৎপাদনের বিকাশ ঘটতে থাকে। কৃষি খাতটি মূলতঃ সবজি,ফলমূল, প্রাণিসম্পদ (মাংস, ডিম,দুধ) ও মৎস্য চাষ। অনেক যুবক ও যুব নারী যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে হাঁস-মুরগী,গবাদি পশুপালন, গরু মোটাতাজাকরন ও মৎস্য চাষ প্রকল্প গ্রহণ করে সফল আত্মকর্মী ও উদ্যোক্তা হয়েছেন। মাংস, ডিম,দুধসহ দৈনন্দিন জীবনে প্রাণিজ খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা পূরণে গুরুত্বপ্র্ণূ অবদান রেখেছে। বর্তমানে বিভিন্ন কারণে যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের এসব কৃষিভিত্তিক প্রশিক্ষণ অনেকটা নিষ্ফল প্রশিক্ষণে পরিণত হতে যাচ্ছে সেই সাথে রাজস্ব বাজেটের একটি বড় অংশ অপচয় হচ্ছে। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের কৃষিভিত্তিক প্রশিক্ষণের বিভিন্ন সমস্যা, সমাধানের উপায় এবং প্রশিক্ষণ অকার্যকর হওয়ার কারণ ও কার্যকরের জন্য বিভিন্ন সংস্কারের মতামত কর্তৃপক্ষের বিবেচনার জন্য একটি ধারনাপত্র তৈরির কাজ করছি।
কৃষি খাত একটি সম্ভাবনাময় খাত। দেশের অপুষ্টি এবং বেকারত্ব দূর করা, কৃষি জমির উর্বরতা বৃদ্ধি নারীর ক্ষমতায়ন মেধাবী জাতি গঠন এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বড় ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে এ খাত। যে কোন খাতে উদ্যোক্তা হতে হলে প্রয়োজন প্রশিক্ষণ, মূলধন ও মুনাফার নিশ্চয়তা। মুনাফার নিশ্চয়তা না থাকলে কোন বিনিয়োগকারীই বিনিয়োগ করবে না। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর প্রশিক্ষণ, মূলধন ও মুনাফার নিশ্চয়তা প্রদান পূর্বক জুলাই-আগস্ট ২০২৪ আন্দোলনে শহীদ পরিবারের সদস্য, আহত পরিবারের সদস্য ও আহতদের চিকিৎসা পরবর্তী টেকসই কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে নিম্নোক্ত প্রকল্পে সফল উদ্যোক্তা তৈরি করতে পারে।
১. ডেইরী ফার্ম প্রকল্প ২. গরু মোটাতাজাকরণ প্রকল্প ৩.ছাগল পালন প্রকল্প ৪.ভেড়া পালন প্রকল্প ৫.সবজি চাষ প্রকল্প ০৬. লেয়ার পালন প্রকল্প ৭.সোনালী বা বিশুদ্ধ জাত মুরগী পালন প্রকল্প ৮. হাসঁ পালন প্রকল্প ৯. কোয়েল পালন প্রকল্প ১০. নার্সারী প্রকল্প ১১. ব্রয়লার পালন প্রকল্প ১২. কৃষিভিত্তিক খাদ্য উৎপাদন প্রকল্প ১৩. মৎস্য চাষ প্রকল্প ১৪.ফুল ও ফল চাষ প্রকল্প ১৫. ঘাস চাষ প্রকল্প
ধাপ-১. প্রশিক্ষণ : উল্লেখিত প্রকল্প গ্রহণের জন্য জুলাই-আগস্ট ২০২৪ আন্দোলনে শহীদ পরিবারের সদস্য,আহত ও আহত পরিবারের সদস্যদেরকে যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের আবাসিকভাবে পরিচালিত তিন মাস মেয়াদী গবাদিপশু পালন,হাঁস-মুরগী পালন,প্রাথমিক চিকিৎসা, মৎস্য চাষ ও কৃষি বিষয়ক প্রশিক্ষণ কোর্সে প্রশিক্ষণ প্রদান করে উক্ত প্রকল্পে দক্ষ করে তুলতে হবে ।
ধাপ-২: প্রকল্পের জন্য ঋণ সহায়তা: সফলভাবে প্রশিক্ষণ শেষ করার পর যুব ঋণ সহায়তার মাধ্যমে প্রকল্প ভিত্তিক সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টাকা ঋণ প্রদান করে উদ্যোক্তা সৃষ্টি করা। ঋণ প্রদানের জন্য বিশ্ব ব্যাংক,বাংলাদেশ ব্যাংক,আইসিবি, যুব ঋণ তহবিল ও অন্যান্য উৎস থেকে অর্থ নিয়ে একটি বিশেষ ঋণ ফান্ড গঠন করা যেতে পারে। ঋণ নিতে ইচ্ছুক প্রকল্প গ্রহনকারী জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে শক্তিশালী ঋণ দান কমিটির বোর্ড ভাইভায় উত্তীর্ণ হতে হবে। মঞ্জুরীকৃত ঋণ প্রকল্প বাস্তবায়নের ভিত্তিতে কয়েক দফায় প্রদান করা হবে। ঋণের বিপরীতে জামানত থাকবে ব্যাংক চেক এবং জামিনদার হিসেবে থাকবে পরিবারের সদস্য। গ্রেস পিরিয়ড প্রকল্পভেদে ৩ মাস থেকে ১ বছর ও পরিশোধ যোগ্য মোট কিস্তি প্রকল্পভেদে ২৪ থেকে ৬০ টি।
সরকারি খাস জমি ও জলাশয় লিজ: বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় যে সমস্ত খাস জমি ও জলাশয় রয়েছে জুলাই-আগস্ট ২০২৪ আন্দোলনে শহীদ পরিবারের সদস্য, আহত পরিবারের সদস্য ও আহতদের টেকসই কর্মসংস্থানের জন্য ৫ বছর মেয়াদী লিজ দেওয়া যেতে পারে ।
ধাপ-৩: মুনাফার নিশ্চয়তা: ২০০০ সালের দিকে কৃষি খাতে বড় বড় কর্পোরেট কোম্পানিগুলো বিনিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধি করেছে বিশেষ করে প্রাণিজ খাদ্য উৎপাদন ও পোল্ট্রি শিল্পে। পোল্ট্রি খাতে স্বল্প সময়ে, স্বল্প পুঁজিতে অধিক মুনাফার সুযোগ থাকায় বিনিয়োগের পরিমান বৃদ্ধির সৃযোগ রয়েছে। দেশের বড় বড় ফার্ম কাজী, আফতাব, সিপি বাংলাদেশ, প্যারাগন, নারিশ ইত্যাদি কোম্পানিগুলো তাদের উৎপাদন এক দিনের মুরগীর বাচ্চা, প্যারেন্ট স্টক, গ্রান্ডপ্যারেন্ট স্টক ও প্রাণিজ খাদ্য ইত্যাদিতে তাদের বিনিয়োগ সীমাবদ্ধ রেখেছিল। বর্তমানে প্রান্তিক খামারীদের সাথে কন্ট্রাক ফার্মিং এর মাধ্যমে তাদের বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। ফলে এ খাতটি কর্পোরেট কোম্পানিগুলো নিয়ন্ত্রণ করে যার কারণে ছোট ও মাঝারী খামারীরা টিকে থাকতে পারছে না। তাই মুনাফার নিশ্চয়তার জন্য কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর সাথে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর কর্তৃক প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত জুলাই-আগস্ট ২০২৪ আন্দোলনে শহীদ পরিবারের সদস্য, আহত পরিবারের সদস্য ও আহতদের কন্ট্রাক ফার্মিং করার জন্য যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর ও কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর সাথে একটি নীতিমালাসহ সমঝোতা চুক্তির প্রয়োজন। প্রতিটি খামারের সবচেয়ে বড় খরচ হচ্ছে খাদ্য খরচ। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর কর্তৃক মঞ্জুরীকৃত ঋণ থেকে চুক্তি মোতাবেক ঋণের একটি বড় অংশ কোম্পানির নিকট জমা থাকবে। কোম্পানিগুলো নির্দিষ্ট মূল্যে খাদ্যসহ অন্যান্য উপকরণ খামারীকে সরবরাহ করবে এবং খামারীর উৎপাদিত পণ্য নির্দিষ্ট মূল্যে কোম্পানি ক্রয় করবে। ফলে প্রতিটি খামারীর মুনাফা নিশ্চিত হবে অপর দিকে কোম্পানির নিকট জমাকৃত মূলধনের উপর সুদ পাবে।
লক্ষ্যমাত্রা: যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর প্রতি অর্থবছরে কৃষি ভিত্তিক বিভিন্ন ট্রেডে ৪১,৫৯,৪০,০০০/- (এক চল্লিশ কোটি ঊনষাট লাখ চল্লিশ হাজার) টাকা প্রশিক্ষণ ব্যয়ে ২,৩১,৫০০ জনকে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে তার মধ্যে য্বু প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর প্রতি অর্থবছরে তিন মাস মেয়াদী আবাসিক প্রশিক্ষণ কোর্সে ৭,৬৮০ জন এবং এক মাস মেয়াদী আবাসিক প্রশিক্ষণ কোর্সে ৯,৬০০ জন মোট ১৭,২৮০ জন যুবদেরকে কৃষিভিত্তিক প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে কিন্তু কাঙ্খিত খামারি বা উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে না। অনেক জেলায় খামারি বা উদ্যোক্তা তৈরির হার শূণ্য। তাই এ প্রকল্পে প্রথম পর্যায়ে জুলাই- আগস্ট ২০২৪ আন্দোলনে শহীদ পরিবারের সদস্য, আহত ও আহত পরিবারের ৬,০০০ হাজার জনকে প্রশিক্ষণ ও যুব ঋণ সহায়তার মাধ্যমে খামারি বা উদ্যোক্তা তৈরি করা যাবে, ফলে পরোক্ষভাবে আরও কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। প্রতিটি খামারী বা উদ্যোক্তা বার্ষিক ১০ লক্ষাধিক টাকা আয় করে দেশের অর্থনীতিতে চাকুরী দাতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি কৃষি খাদ্য পণ্য যেমন- ডিম, দুধ , মুরগীর মাংস, গরুর মাংস ও শাক সবজি ইত্যাদির চাহিদা পূরণ এবং বাজার মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা যাবে ।