পূর্ব দিগন্তে সূর্য ওঠেছে
প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ আগস্ট ২০২৪, ১২:৩৫:০২ অপরাহ্ন
‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য ওঠেছে রক্ত লাল রক্ত লাল’। উনিশ শো একাত্তর সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোতে সহ¯্রবার গাওয়া একটি জনপ্রিয় গানের একটি পংক্তি এটি। যারা তখন ছিলেন তাদের সকলের স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে এই সংগীতের কথা, তাদের কর্ণকূহরে আজো অনুরণিত হচ্ছে এই প্রাণদায়ী উজ্জীবক গানের সুর। স্বাধীনতা লাভের অর্ধ শতাব্দি পর আবার সেই সংগীত উজ্জীবিত করেছে এদেশের মানুষকে। গত ক’দিন ধরে বার বার উচ্চারিত হচ্ছে, বার বার বাজছে। গানটির এই কালজয়ী পংক্তি। পরিস্থিতির সাথে মিলে যাওয়ায় জনগণ আবারো গেয়েছে এই গান। এর সাথে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও যুদ্ধকালে গাওয়া আরো অনেকগুলো গান। এই গানগুলো উদ্বুদ্ধ করেছে স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই ও সংগ্রামে। নতুন প্রভাতে নতুন সূর্য রক্তবর্ণে রঞ্জিত হয়ে উদিত হয়েছে শেষ পর্যন্ত এদেশের পূর্ব দিগন্তে।
দীর্ঘ প্রায় দেড় দশকেরও বেশী সময়ব্যাপী অগণিত খুন, গুম, নিপীড়ন, নির্যাতন ও হুমকি-ভীতি প্রদর্শন মোকাবেলা করে এদেশের মুক্তিকামী জনগণ গতকাল স্বৈরাচারী ঘাতক হাসিনা সরকারের রাহুগ্রাস থেকে বাংলাদেশকে শেষ পর্যন্ত মুক্ত করেছে। স্বাধীন বাংলাদেশ আবারো স্বাধীন হয়েছে, এমন শ্লোগান ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। সত্যি বলতে কি বিগত বছরগুলোতে হাসিনা সরকারের চাপিয়ে দেয়া জগদ্দল পাথর সম শোষণ নির্যাতন খুন গুম থেকে রেহাই পেয়ে মুক্তির প্রকৃত স্বাদ পেয়েছে এদেশে কোটি কোটি সাধারণ মানুষ। যারা এতোদিন সকল ক্ষেত্রে পেয়েছে শুধুই বঞ্চনা। বঞ্চনা নিপীড়ন নির্যাতনে তারা পরিণত হয়েছে ইতিহাসের অন্যতম প্রলেতারিয়েত বা সর্বহারা গোষ্ঠীতে। শাসকগোষ্ঠী দেশের সবচেয়ে লুক্রেটিভ বা আকর্ষণীয় সরকারী চাকরীসহ ব্যবসা বাণিজ্য ব্যাংক ঋণ সকল ক্ষেত্রে তাদের লোভের নখর বসিয়ে খুবলে খুবলে খেয়েছে এতোদিন। কয়েক লক্ষ মানুষ দেশের সম্পদ ও সুযোগ সুবিধার ৯০/৯৫ ভাগ কুক্ষীগত করে রাখে। অবশিষ্ট ১৭/১৮ কোটি মানুষ প্রকৃত অর্থেই উচ্ছিষ্টভোগীতে পরিণত হন। সরকারী চাকরীতে শতকরা প্রায় ৫০ ভাগই নানা কোটার নামে অন্যায়ভাবে কুক্ষীগত করে রাখে ক্ষমতাসীন দল তথা সরকার। এভাবে প্রশাসনের সকল স্তর নিজেদের পছন্দসই আমলা কর্মকর্তা দিয়ে পূর্ণ করে ফেলা হয়। এভাবে দলীয়করণ থেকে রেহাই পায়নি বিচার বিভাগসহ কোন বিভাগই। বিরোধী দলগুলো এতে ক্ষুব্ধ হলেও ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে সফল আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। আওয়ামী লীগ সরকার কঠোর হস্তে দমন করতে সক্ষম হয় সকল বিরোধী দলকে। শেষ পর্যন্ত সাধারণ শিক্ষার্থী বিশেষভাবে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৈষম্যমূলক কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে। তারা দেখতে পায়, বিদ্যমান বৈষম্যমূলক কোটা ব্যবস্থা বহাল থাকলে কোনদিনই তারা সরকারী চাকরী লাভে সক্ষম হবে না, সক্ষম হবে না নিজেদের ভবিষ্যত গড়াসহ দেশ পরিচালনার সুযোগ পেতে। তাই এক সময়ে বাতিল কোটা ব্যবস্থা আবার চালু করা হলে তারা বিক্ষোভে রাস্তায় নেমে আসে। আর সরকারও এই বিক্ষোভকে কঠোর হস্তে দমন করতে গিয়ে ব্যাপক হত্যাকান্ড সংঘটিত করে। যার ফলে কোটা আন্দোলন হাসিনা সরকারের পতনের এক দফা দাবিতে পরিণত হয়। দেশের আপামর জনগণ আগে থেকেই চরম ক্ষুব্ধ ছিলো এই কর্তৃত্ববাদী সরকারের প্রতি। বিশেষভাবে একনায়ক হাসিনার প্রতি তাদের ক্ষোভ ছিলো সীমাহীন। তাই ছাত্রদের এই আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যুক্ত হয় দেশের প্রায় সকল রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ। তাদের অনেক ত্যাগ তিতীক্ষা ও প্রাণ উৎসর্গের বিনিময়ে হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটেছে গতকাল। এতে দেশজুড়ে এখন বিজয় উল্লাস, মুক্তির উৎসব চলছে। এ অবস্থায় দেশের বিভিন্ন স্থানে কিছু লুটপাট সম্পদ ধ্বংস ও খুন খারাবির মতো ঘটনার সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক ও অনভিপ্রেত। রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস ঠেকাতে ও খুন খারাবি বন্ধে একটি শক্তিশালী ও কার্যকর অন্তবর্তীকালীন সরকারের তীব্র প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন দেশের সচেতন ও শান্তিপ্রিয় জনগণ। স্বৈরাচারী সরকারের বিদায়ে যেহেতু দেশের সশস্ত্র বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, তাই এই গোলযোগপূর্ণ সময়ে তথা ক্রান্তিলগ্নে তারা ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে, এমন প্রত্যাশা জনগণের। আমরা এই আন্দোলন সংগ্রামে জীবনোৎসর্গকারী ছাত্র জনতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি ও আশু সুস্থতা কামনা করছি আহত ও পঙ্গুত্ববরণকারী সংগ্রামী ছাত্র জনতার।