বিচারপতির বিচার হবে
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ আগস্ট ২০২৪, ১২:২১:৪০ অপরাহ্ন
বিখ্যাত গীতিকার সলিল চৌধুরীর লেখা একটি বহুল প্রচারিত দেশাত্ববোধক গানের প্রথম দু’টি পংক্তি হচ্ছে: ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা/ আজ জেগেছে এই জনতা, এই জনতা’। ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এই উপমহাদেশের সংগ্রামী মানুষের মনের কথা প্রকাশিত হয়েছে এই গানের প্রতিটি পংক্তিতে। কিন্তু শিল্প সাহিত্য ও সংগীত তো কালজয়ী, তা কোন সময় বা কালের মধ্যে সীমিত বা সীমাবদ্ধ থাকে না।
শেখ হাসিনা সরকারের অসংখ্য অপকর্মের দোসর, এদেশের বিচার ব্যবস্থা ধ্বংসের অন্যতম হোতা এবং অগণিত জুডিশিয়াল কিলিংয়ের নেপথ্য নায়ক বিতর্কিত বিচারপতি মানিক হিসেবে পরিচিত শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের গ্রেফতারের ঘটনায় উপরোক্ত গানের পংক্তি দু’টি অনেকের মনে জাগছে। গতকাল মিডিয়ায় প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে আটক করা হয়েছে।
ভারতে পালিয়ে যাওয়ার প্রাক্কালে সিলেটের কানাইঘাট সীমান্ত থেকে তাকে আটক করে বিজিবি। আটকের পর প্রচারিত এক ভিডিওতে দেখা যায়, তার সামনে অবস্থান করা লোকদেরকে বিচারপরতি মানিক বলেছেন, ‘আমি তোমাদের পয়সা দিয়ে দেবো। পয়সা আমি দেবো, আমার ভাইবোন দেবে। জবাবে তাদের মধ্যে একজনকে বলতে শোনা যায়, আমাদের পয়সার প্রয়োজন নেই। এরপর মানিককে বলতে শোনা যায়, ওই ফালতু লোক দু’টাকে আনিও না। আমি এদেশে এসেছি কি বাংলাদেশে ফেরত যাওয়ার জন্য’। বিজিবি সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদে মানিক স্বীকার করেছেন, তিনি ১৫ হাজার টাকার কন্ট্রাক্টে ভারতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু দু’জন লোক ভারতের ভেতর নিয়ে তাকে মারধর করে ৭০ লাখ টাকা নিয়ে যায়। বিচারপতি মানিক আপিল বিভাগের বিচারপতি ছিলেন। ২০১৫ সালে তিনি অবসরে যান।
অবসরপ্রাপ্ত এই বিচারপতি দীর্ঘদিন ধরেই দেশে বেশ আলোচিত। নানা কারণে তুমুল সমালোচিত। সবশেষে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় একটি টিভি চ্যানেলের টকশোতে নারী উপস্থাপিকার সাথে বাজে আচরণ করে আবার আলোচনায় আসেন। ওই অনুষ্ঠানে নারী উপস্থাপিকাকে ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে সম্বোধন করেন। আবার যারা মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল বা সংস্কার চায় সেসব শিক্ষার্থীও রাজাকারের বাচ্চা বলে মন্তব্য করেন এই সাবেক বিচারপতি।
এছাড়া জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর মাওলানা দেলওয়ার হোসাইন সাঈদীর আপিলের রায়ের বেঞ্চেও মানিক ছিলেন অনন্য। রায়ে কেবলমাত্র তিনিই দেলওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছিলেন। এই মৃত্যুদণ্ডাদেশকে কেন্দ্র করে সাঈদী অনুসারী ভক্ত অনুরাগীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। যার ফলশ্রুতিতে বহু লোক নিহত হন। এছাড়া আরো অনেক মামলায় বিতর্কিত রায় দেয়াসহ বহু জুডিশিয়াল কিলিংয়ের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
অভিযোগ রয়েছে, ২১ বিচারককে ডিঙিয়ে মানিককে বিচারপতি নিয়োগ দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। এক ট্রাফিক সার্জেন্টেকে হাইকোর্টের বিচারকের গাড়িকে সালাম না দেওয়ার কারণে আদালতে কান ধরে উঠবস করিয়েছিলেন মানিক। সেই প্রেক্ষাপটে পুলিশের তৎকালীন মহাপরিদর্শক শহীদুল হক বলেছিলেন, ট্রাফিক পুলিশ কাউকে অভিবাদন জানাতে বাধ্য নয়। পরে শহীদুল হকের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল জারি করা হয়। এতে আইন অনুসারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মহাপরিদর্শকের পদ হারান তিনি। পরে রাষ্ট্রপতির ক্ষমার কারণে শহীদুল হক চাকরী ফিরে পান।
এছাড়া বিমানে ইকোনমি ক্লাসের টিকেট কিনে জোরপূর্বক বিজনেস ক্লাসের আসনে বসে লন্ডনে যাওয়ার মতো কীর্তি রয়েছে বিচারপতি মানিকের। তিনি ৩২ হাজার পাউন্ড দিয়ে লন্ডনে তিনটি বাড়ি কিনেছেন। বাড়ি ছাড়াও লন্ডনে আরো সম্পত্তি রয়েছে তার। কিন্তু সেই আয়ের উৎস প্রকাশ করেননি তিনি। অবসর নেওয়ার কয়েক মাস পর মানিক অনেক মামলার রায় লিখেছিলেন। তার বিতর্কিত রায়ের কারণে বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট মানিকের রায় দেয়া ১৬১টি মামলা পরিহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়েও হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে বিচার কাজ চালিয়ে গেছেন মানিক। দেশের কোন আইন কানুনের তোয়াক্কা করেননি তিনি।
অভিযোগ রয়েছে, বিচারপতি মানিক দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতি, যাকে ইচ্ছা তাকে নির্যাতন ও হয়রানি করেছেন। তার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় আইন লংঘন ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে সম্পদের হিসাব গোপন এবং সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের শপথ ও আচারণবিধি ভঙ্গের মতো অভিযোগও রয়েছে।
যা-ই হোক, সীমান্ত নিয়ে অবৈধভাবে পালানোর সময় এই বিচারক নামের কলঙ্ক শরিফুদ্দিন মানিক ধরা পড়েছেন। ধরা পড়ার পর লোকজন তাকে গরু বাঁধার দড়ি দিয়ে চেয়ারের সাথে বেঁধে রাখে। তার গলায়ও দড়ি বাঁধা দেখা যায়। প্রাথমিকভাবে এলাকার আটককারী লোকজন জেনেশুনেই তার সাথে এমন আচরণ করে, যাতে তার প্রতি জনগণের তীব্র ঘৃণা ও ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে।
অবস্থাস্পৃষ্টে মনে হয়েছে, বিচারপতি মানিক ক্ষমতার বলে এতোদিন অবিচার করেছেন, এখন সে সবের জন্য তাকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে, জনগণ সেটাই চাইছে। তার ক্ষেত্রে এখন সলিল চৌধুরীর উপরোক্ত গানের পংক্তি দু’টি জীবন্ত সত্য হয়ে ওঠেছে।