এক জঘন্য অপরাধের নাম গুম
প্রকাশিত হয়েছে : ৩০ আগস্ট ২০২৪, ১২:৩০:০৫ অপরাহ্ন
গুম বিষয়ক আন্তর্জাতিক কনভেনশনে সই করেছে বাংলাদেশ। গুম থেকে নাগরিকদের সুরক্ষা বিষয়ক এই আন্তর্জাতিক কনভেনশন বা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। প্রতি বছর ৩০ আগস্ট জোরপূর্বক গুমের শিকার ব্যক্তিদের জন্য আন্তর্জাতিক দিবস পালন করা হয়। এ বছর দিবসটির একদিন আগে বাংলাদেশ এতে সই করলো। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এই মুহূর্তকে ‘ঐতিহাসিক’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এর আগে শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে নিরাপত্তা বাহিনীর মাধ্যমে ১৫ বছরে গুম হওয়া প্রতিটি ঘটনা তদন্তে এই সপ্তাহের শুরুতে অন্তর্বর্তী সরকার একটি কমিশন গঠন করেছে। পাঁচ সদস্যের এই কমিশনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন হাইকোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি। গত ২৭ আগস্ট এ বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রীপরিষদ বিভাগ।
তদন্ত কমিশন আইন ১৯৫৬ এর ক্ষমতাবলে গঠিত এই কমিশন প্রসঙ্গে এই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, আইনশৃঙ্খলা প্রয়োগকারী সংস্থা তথা বাংলাদেশ পুলিশ, র্যাব, বর্ডার গার্ড, সিআইডি, বিশেষ শাখা, গোয়েন্দা শাখা, আনসার ব্যাটালিয়ান, জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই), প্রতিরক্ষা বাহিনী, ডিজিএফআই ও কোস্ট গার্ডসহ দেশের আইন প্রয়োগ ও বলবৎকারী সংস্থার কোন সদস্য কর্তৃক জোরপূর্বক গুম হওয়া ব্যক্তিদের জন্য এই কমিশন গঠন করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গুমের অভিযোগ নিয়ে গত দেড় দশকের বেশি সময় ধরে আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের সমালোচনা রয়েছে। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ‘আয়নাঘর’ হিসেবে পরিচিত গোপন বন্দীশালা থেকে দীর্ঘসময় পর বেশ কয়েক ব্যক্তি মুক্ত হওয়ার পর গুমের বিষয়টি জোরালোভাবে সামনে আসে।
বেসরকারী মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে ৭শ’র বেশি মানুষ গুম হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ১৫০ জনেরও বেশি মানুষের খোঁজ পাওয়া যায়নি আজও। বাংলাদেশ জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক ৯টি সনদের ৮টিতে সই করেছে। জাতিসংঘের দীর্ঘদিনের অনুরোধের পরও বিগত হাসিনা সরকার গুমবিরোধী সনদে স্বাক্ষর করেনি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মানবাধিকার সমুন্নত রাখার পাশাপাশি গুমের সংস্কৃতি বন্ধ করতে চায়। এ লক্ষ্যে সরকার গুমবিরোধী সনদে যুক্ত হয়েছে। নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রতিটি গুমের তদন্ত ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার বিষয়ে দেশবাসীর কাছে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে।
গত সোমবার জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, র্যাবসহ সরকারী বাহিনীর যেসব সদস্য গুম, খুন, নির্যাতনের মত অপরাধে যুক্ত ছিলেন, তাদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেয়া হবে। এই কমিশনের কার্যপরিধিতে ২০১০ সালের ১ জানুয়ারী থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান, তাদের শনাক্ত এবং কোন পরিস্থিতিতে গুম হয়েছে, তা নির্ধারণের মত ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।
গুম বিরোধী জাতিসংঘের সনদটি ২০০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে গৃহীত হয়। ৩২টি দেশ এটি অনুস্বাক্ষরের পর ২০১০ সালে তা বাস্তবায়ন শুরু হয়। বাংলাদেশের গুম বিরোধী সনদে স্বাক্ষর এবং কমিশন গঠনের ফলে গুম হওয়া পরিবারগুলোর মাঝে স্বস্তি ও আশার সঞ্চার হয়েছে। তাদের মাঝে আশা জাগছে, গুম হওয়া স্বজনদের তারা ফেরত পাবে কিংবা গুমের সাথে জড়িতরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পাবে।
বলা বাহুল্য, গুম হচ্ছে কোন ব্যক্তিকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর তাঁর খোঁজ না মেলা। জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক হওয়ার পর কোন ব্যক্তিকে যদি বিচার ব্যবস্থার কাছে সোপর্দ না করা হয় এবং তাকে আর খোঁজে না পাওয়া যায়, তবে সেটিকেই গুম হিসেবে ধরা হয়।
বাংলাদেশে সর্বাধিক আলোচিত গুমের ঘটনার মধ্যে ইলিয়াস আলী, একরামুল, চৌধুরী আলম ও নারায়ণগঞ্জে র্যাব কর্তৃক ৭ জনের গুমের ঘটনা উল্লেখযোগ্য। এসব ঘটনা যেমন মর্মান্তিক তেমনি সংশ্লিষ্টদের পরিবার পরিজনদের কাছে নিদারুন দুঃখ ও বেদনার। এসব গুম খুনের ঘটনাসহ অন্যান্য সকল গুমের ঘটনার সাথে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান দেশের সকল সচেতন ও বিবেকবান মানুষ, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের গুম খুনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর কখনো না ঘটে।