মেগা প্রকল্পের ফাঁদে দেশ
প্রকাশিত হয়েছে : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:৩২:১০ অপরাহ্ন
গতকাল একটি জাতীয় মিডিয়ায় ‘কর্ণফুলী টানেলে দৈনিক আয় ১২ লাখ, ব্যয় ৩৭ লাখ’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এতে গত সাড়ে ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের নজর বেশি ছিলো অবকাঠামো উন্নয়নে। একের পর এক মেগা প্রকল্পের নামে বিদেশী ঋণ নেয়া হয়েছে। পঞ্চ বার্ষিক পরিকল্পনাগুলোকে পাশ কাটিয়ে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে বিনিয়োগ হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে অন্যতম বড়ো প্রকল্প চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত ট্যানেল। অর্থনৈতিক করিডোরের কথা চিন্তা করে এ প্রকল্প নেওয়া হলেও সেখানে বিনিয়োগের তেমন দেখা নেই। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে যে পরিমাণ গাড়ি চলাচলের কথা ছিলো তার সিকিভাগও সেখানে চলছে না। ফলে টোল আদায় কম হচ্ছে। আয়ের চেয়ে টোল আদায় ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয় এখন পর্যন্ত বেশি।
বলা বাহুল্য, উপরোক্ত কর্ণফুলী ট্যানেলসহ আরো বহু সেতু স্থাপনা ও অবকাঠামো তৈরি হয়েছে বৈদেশিক ঋণের অর্থে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রয়োজন, অগ্রাধিকার ও আর্থিক লাভ বা ফায়দার বিষয় বিবেচনা না করেই এগুলো তৈরি বা নির্মাণ করা হয়েছে।
পতিত হাসিনার চরম দুর্নীতিবাজ সরকার এক্ষেত্রে যে বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়েছে, তা হচ্ছে কমিশন বাণিজ্য। ‘যতো বেশি মেগা প্রকল্প ততো বেশি কমিশন’ এই নীতি নিয়ে গত সাড়ে ১৫ বছরে অনেকগুলো বড়ো বড়ো মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এগুলো ব্যয় দেখানো হয়েছে প্রকৃত ব্যয়ের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। এগুলোর মধ্যে যে পদ্মা সেতু ১০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা সম্ভব, এতে ব্যয় দেখানো প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। একইভাবে যে রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্পের অনুরূপ প্রকল্প ভারতে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলারে তৈরি করা হয়েছে, বাংলাদেশে এর ব্যয় দেখানো হয়েছে এর দ্বিগুণেরও বেশি। আবার এই অর্থের মধ্যে ৫০০ কোটি ডলার কমিশন হিসেবে পেয়েছেন শেখ হাসিনার পুত্র জয়সহ তার পরিবার, এমন তথ্য একটি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক সংস্থার। এভাবে মেগা প্রকল্পের নামে সীমাহীন লুটপাটের যে মচ্ছব চলেছে বিগত সাড়ে ১৫ বছর ধরে, এর খেসারত হিসাবে বাংলাদেশের সাড়ে ১৫০ বিলিয়ন ডলারের ঋণের বোঝা চেপেছে। দেশের প্রতিটি নাগরিকের ঘাড়ে পড়েছে ৬০ হাজার টাকা। এসব ঋণ বাংলাদেশকে সুদ আসলে পরিশোধ করতে হবে কয়েক যুগ ধরে।
বলা বাহুল্য, এসব মেগা প্রকল্পের পেছনে হাসিনার দু’টি অশুভ উদ্দেশ্য ছিলো। একটি হলো এগুলোর মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির বাগাড়ম্বর বা প্রচারণা, অপরটি হলো লক্ষ কোটি টাকার কমিশন বাণিজ্য। সেতু ও স্থাপনা তৈরি করে জনগণের সামনে উন্নয়নের কথা প্রচার করা যতো সহজ, দারিদ্র্য বিমোচনে হাজার কোটি ব্যয় করে তা স্থূল বা দৃশ্যমানভাবে প্রচার প্রোপাগান্ডা করা সম্ভব নয়। বেকারত্ব দূরীকরণ ও দারিদ্র্য বিমোচনের কাজ করতে হয় সমাজের গভীরে বা অভ্যন্তরে, যা সহজে বুঝা যায় না। কিন্তু পদ্মা সেতুর মতো একটি সেতু বা কর্ণফুলী টানেলের মতো একটি টানেল সহজেই সবার চোখে পড়ে। এগুলো নিয়ে প্রচারণা চালানো সহজ। আর এই কাজটিই করেছে দুর্নীতিবাজ হাসিনা সরকার।
অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয়, বৈশি^ক ঋণের অর্থে যখন দেশে লক্ষ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ হচ্ছিলো, তখন দেশের ৬০-৭০ ভাগ মানুষ ছিলো দারিদ্র্য সীমার নিচে। ৪০-৫০ শতাংশ মানুষ ছিলো হতদরিদ্র্য, যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। এ সময়ে তরুণ যুবাসহ ৪/৫ কোটি মানুষ ছিলো সম্পূর্ণ বা অর্ধবেকার। এই দারিদ্র্য ও বেকারত্ব দূরীকরণে অর্থ ব্যয় না করে স্বৈরাচারী সরকার লক্ষ কোটি টাকা ব্যয় করেছে মেগা প্রকল্পের পেছনে। শিল্প কারখানা এমনকি নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ স্থায়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়তেও আগ্রহী ছিলো না তারা। আগ্রহী ছিলো না দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে। এভাবে এদেশের অধিকাংশ দরিদ্র ও সীমিত আয়ের মানুষ আরো দরিদ্র হয়েছে। পুরো মধ্যবিত্ত শ্রেণি পরিণত হয়েছে দরিদ্র শ্রেণিতে। প্রয়োজন ও অগ্রাধিকারের বিচারে অনেক নিচে অবস্থান করা এ সব প্রকল্প নিয়ে অনেক ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিব্রত ও সমস্যায় আছেন। নতুন সরকার চেষ্টা করছেন এগুলোকে লাভজনক করতে, নিদেনপক্ষে ক্ষয়ক্ষতি থেকে তুলে আনতে। আশা করা যায়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিগত স্বৈরাচারী সরকারের মেগা প্রকল্পের এই ফাঁদ থেকে দেশ ও দেশের জনগণকে পুনরুদ্ধারে সক্ষম হবেন এবং মেগা প্রকল্পগুলো লাভজনক হয়ে ওঠবে ধীরে ধীরে।