বিদ্যুৎ সংকটের নেপথ্যে
প্রকাশিত হয়েছে : ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০৫:৪৩ অপরাহ্ন
মারাত্মক লোডশেডিংয়ের কারণে বিপাকে পড়েছেন সিলেট বিভাগের ব্যবসায়ীসহ সকল শ্রেণীর মানুষ। এ অবস্থায় গতকাল ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান না হলে ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নামার ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি সিলেট জেলা শাখা, সিলেট মহানগর ও জেলা ব্যবসায়ী ঐক্য কল্যাণ পরিষদের নেতৃবৃন্দ। এক বিবৃতিতে তারা বলেন, সিলেটে অতিরিক্ত লোডশেডিংয়ের কারণে ব্যবসায়ীরা মারাত্মক ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছেন। প্রতি আধা ঘণ্টা পর পর লোডশেডিংয়ের কারণে প্রভাব পড়ছে ব্যবসা বাণিজ্যে। সিলেট বিভাগে ১৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হলেও পুরো বিভাগের ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে না। এক্ষেত্রে মারাত্মক বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন সিলেটবাসী। ভয়াবহ লোডশেডিংয়ের কারণে বিপাকে পড়েছেন বিসিক শিল্পনগরীর উদ্যোক্তারাও। ঘন্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের ফলে উৎপাদনে ধস নেমেছে বলে জানিয়েছেন তারা। এভাবে চলতে থাকলে উৎপাদন বন্ধ করা ছাড়া উপায় থাকবে না বলে জানিয়েছেন তারা।
এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সিলেট বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী বলেন, তীব্র গরমের কারণে হঠাৎ করেই বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে উৎপাদন ঘাটতি থাকায় প্রয়োজন অনুযায়ী সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। বলা বাহুল্য, জ্বালানী নিশ্চিত না করেই একের পর এক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। চাহিদাকে বিবেচনায় নেয়নি তারা। ফলে প্রতি বছর বড়ো সময় অলস বসিয়ে রাখতে হয়েছে বিদ্যুৎ কেন্দ্র। দিতে হয়েছে অলস সময়ের ভাড়া। খরচের চাপ সামলাতে ভোক্তা পর্যায়ে দাম বেড়েছে সরকারের দায় বেড়েছে। অথচ তিন বছর ধরে গরম বাড়লেই লোডশেডিংয়ের কবলে পড়তে হচ্ছে জনগণকে। নতুন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েও পড়েছে একই সমস্যায়। বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালানোর জন্য পর্যাপ্ত জ্বালানী নেই। গত সোমবার গড়ে ২ হাজার মেগাওয়াটের বেশী লোডশেডিং করতে হয়েছে। গতকাল একটি জাতীয় মিডিয়ায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত তিনদিন ধরে লোডশেডিং বেড়েছে। ঢাকার বাইরে কোন এলাকায় গ্রামাঞ্চলে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না সাধারণ মানুষ। যদিও দেশে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ২৭ হাজার ৭৯১ মেগাওয়াট। অথচ চাহিদা এখন ১৬ হাজার মেগাওয়াটেরও কম।
পিডিবি সূত্র জানিয়েছে, সামিট মালিকানাধীন তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহের একটি টার্মিনাল তিন মাস ধরে বন্ধ। এতে গ্যাসের সরবরাহ বাড়ছে না। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে এক হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন কমেছে।
বিল বকেয়া থাকায় আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে সরবরাহ কমেছে ৫শ মেগাওয়াট। বেসরকারী খাতের তেলচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকেও সর্বোচ্চ চাহিদায় উৎপাদন করা যাচ্ছে না। কারণ তারাও অনেক টাকা পাবে। তাই ঘাটতি পূরণে লোডশেডিং করতে হচ্ছে। এতে আরো বলা হয়েছে, দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয়। কক্সবাজারের মহেষখালিতে দু’টি ভাসমান টার্মিনালের মাধ্যমে এলএনজি থেকে আসে ১১০ কোটি ঘনফুট। সামিটের এলএনজি টার্মিনাল গত ২৭ মে থেকে বন্ধ। এতে এলএনজি সরবরাহ দাড়িয়েছে দৈনিক ৬০ কোটি ঘনফুট। সার্বিকভাবে দিনে এখন গ্যাস সরবরাহ নেমে এসেছে ২৬০ কোটি ঘনফুটে। বিদ্যুৎ খাতে গ্যাস সরবরাহ কমে দাঁড়িয়েছে ৮২ কোটি ঘনফুট। আড়াই মাস আগেও গ্যাস থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো। এখন হচ্ছে ৫ হাজার মেগাওয়াট। ভারতের ঝাড়খন্ডে নির্মিত আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে দৈনিক দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করার কথা। তাদের বিদ্যুৎ বিল পাওনা দাঁড়িয়েছে ৮০ কোটি ডলারের বেশী অর্থাৎ প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ৫০ কোটি ডলার পরিশোধের নির্ধারিত সময় পার হয়ে গেছে। বকেয়া বিল পরিশোধে চাপ দিচ্ছে তারা। যদিও আদানির সাথে অসম ও আর্থিক দিক দিয়ে ক্ষতিকর চুক্তির ফলে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ অতিরিক্ত কয়েক হাজার কোটি টাকা গচ্ছা দিতে হয়েছে। তাদের সাথে ১৫ বছর মেয়াদী এই চুক্তি পুনর্বিবেচনা বা বাতিল করা না হলে বাংলাদেশের জন্য দীর্ঘস্থায়ী ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়তে হবে।
স্বৈরাচারী হাসিনা নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে আদানির জন্য জাতীয় স্বার্থ বিরোধী এই চুক্তি করে। আদানি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। আদানির এই চুক্তি নিয়ে দেশে বিদেশে বিস্তর সমালোচনা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। খোদ ভারতেই এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন রাজনৈতিক মহল।
যা-ই হোক, সবশেষে এটুকু বলা যায়, হাসিনা সরকারের বিদ্যুৎ খাতে সীমাহীন দুর্নীতির খেসারত দিতে হচ্ছে এখন বাংলাদেশকে। কিন্তু খেসারতের কথা ভেবে বর্তমান সরকারকে বসে থাকলে তো এ সমস্যার সমাধান হবে না। বিদ্যুতের মতো অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির সুরাহা করতে হবে অবিলম্বে। নইলে জীবনযাত্রা অসহনীয় হয়ে ওঠার পাশাপাশি দেশের উৎপাদন ও ব্যবসা বাণিজ্যে যে ধস নেমে আসবে, এতে কোন সন্দেহ নেই।