আলু রফতানিকারক থেকে আমদানিকারক!
প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:৩৫:০২ অপরাহ্ন
নিত্যপণ্য নিয়ে কারসাজি অব্যাহত। গণঅভ্যূত্থানের আগে এ নিয়ে যে কারসাজি ছিলো তাতে ভাটা পড়েনি পট পরিবর্তনের পরে। অনেক নিত্যপণ্যের দাম ইতোমধ্যে কমলেও আলুর মতো অতি প্রয়োজনীয় সবজি বা সামগ্রীর দাম এখনো সাধারণ সীমিত আয়ের মানুষের জন্য অসহনীয়। এ অবস্থায় ভারত থেকে আলু আমদানির মাধ্যমে এই পণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। বিষয়টি বাংলাদেশের মতো বদ্বীপ উর্বর মাটির দেশের জন্য রীতিমতো লজ্জাজনক, যেখানে পর্যাপ্ত আলু উৎপাদিত হচ্ছে। আলুর এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির পেছনে একশ্রেণীর মজুতদার লোভী ব্যবসায়ীর কারসাজি বিশেষভাবে দায়ী। গত এপ্রিলে মিডিয়ায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই কারসাজি নিয়ে তথ্য প্রকাশিত হয়। ‘ব্যবসায়ীরা এবার কেন এতো আলু কিনলেন’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, অভিযোগ ওঠেছে, ব্যবসায়ীর কারসাজিতে দাম বেড়েছে। তারা ব্যাপক হারে আলু কিনে নিয়েছেন, যাতে পরে বাজার তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন। রাজশাহীতে এবার মাঠেই প্রায় তিনগুণ দামে আলু বিক্রি হচ্ছে। গত বছরে কৃষকেরা মাঠ পর্যায়ে যেখানে প্রতি কেজি আলু ১১-১২ টাকায় বিক্রি করেছিলেন, সেখানে এবার বিক্রি হচ্ছে ৩৩ টাকায়। কৃষকেরা বলছেন, ব্যবসায়ীরা মাঠ থেকেই চড়া দামে আলু কিনে নিচ্ছেন। সেজন্য তারা সব আলু বিক্রি করে দিচ্ছেন। অন্যদিকে অভিযোগ ওঠেছে, ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে দাম বাড়িয়ে ব্যাপক হারে আলু কিনে নিয়েছেন, যাতে পরে বাজার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে একচেটিয়া মুনাফা করতে পারেন।
সরকারী বিপণন কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে দাম বাড়িয়েছেন। তারা আলু কিনে গুদামজাত করে রাখছেন। এতে কৃষকেরা আপাতত লাভবান হলেও পরে ব্যবসায়ীরা বাজার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে একচেটিয়া ব্যবসার জন্য এমনটি করছেন। এসব অপতৎপরতার ফলে পর্যাপ্ত আলু উৎপাদন সত্বেও বিদেশ থেকে আলু আমদানি করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। বর্তমানে বাজারে প্রতি কেজি আলুর দাম ৫০-৫৫ টাকা। ভারত থেকে আলু আমদানির খবরে দাম ২-৪ টাকা কমার খবর পাওয়া গেছে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) পরিসংখ্যান অনুসারে, আলু উৎপাদনে বিশ্বে সপ্তম স্থানে বাংলাদেশ। দেশে আলুর বার্ষিক অভ্যন্তরীন চাহিদা প্রায় ৩-৫ লাখ টন। উৎপাদিত হয় প্রায় দেড়শ টন। মাত্র কয়েক মাস আগেও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, সরকারের প্রণোদনা ও কৃষি গবেষকদের চেষ্টায় বাংলাদেশ এখন আলুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ। প্রতি বছরই আলু রপ্তানী হচ্ছে। এই বক্তব্য মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করে আলু রপ্তানিকারক বাংলাদেশকে কেনো ভারত থেকে আলু আমদানী করতে হচ্ছে, তা অনেকেরই বোধগম্য হচ্ছে না। সচেতন মহল মনে করেন, একশ্রেণীর কোল্ড স্টোরেজের মালিক এবং আলু মজুতদার ব্যবসায়ীর অতি মুনাফার কারণে বাজারে আলুর দাম বেড়েছে। আর এসব ব্যবসায়ীদের কারসাজি বন্ধে ব্যর্থ হয়ে সরকারকে আলু বাজার স্থিতিশীল রাখতে বাইরে থেকে আলু আমদানি করতে হচ্ছে। মুনাফাখোর মজুতদার আলু ব্যবসায়ীদের কারসাজি বন্ধে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় তথা সরকারের ব্যর্থতা যেমন লজ্জাজনক তেমনি অর্থনীতির জন্য অশনি সংকেতস্বরূপ।
বলা বাহুল্য, ভাতের পর এখন দেশের দ্বিতীয় প্রধান খাদ্যশক্তির উৎস আলু। কৃষি বিজ্ঞানীদের অদম্য প্রচেষ্টা ও চাষিদের পরিশ্রম আর কৃষি বিভাগের সহায়তায় বাংলাদেশে উৎপাদিত হচ্ছে প্রচুর আলু। ভর্তা ভাজি আর তরকারির গন্ডি ছাড়িয়ে আলু এখন ফ্রেঞ্চফ্রাই, পটেটো চিপস বা পটেটো ক্লেক্স হিসেবে প্যাকেটজাত হয়ে বিদেশেও পাড়ি দিচ্ছে। গত এক যুগে দেশে অর্ধ শতাধিক আলু প্রক্রিয়াজাত পণ্য উৎপাদন কারখানা স্থাপিত হয়েছে। এর মধ্যে কমপক্ষে ৮টি কোম্পানী আলু থেকে উৎপাদিত চিপস ও ফ্রেঞ্চফ্রাই বিদেশে রপ্তানি করছে। জানা গেছে, গত এক যুগে দেশের বিজ্ঞানীরা প্রায় ৭০টি আলুর জাত উদ্ভাবন করেছেন। মূলতঃ ২০০২ সাল থেকে বাংলাদেশে আলু উৎপাদন ব্যাপক হারে বাড়তে থাকে। বাংলাদেশে উৎপাদিত আলু মাত্র কিছুকাল আগেও যিবদেশে রপ্তানি হয়েছে। বাংলাদেশের চাহিদা মিটিয়ে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া ও ইউরোপের ১১ টি দেশে আলু রপ্তানি করা হয়। আলু থেকে অর্জিত হয় প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। কিন্তু কয়েক মাসের ব্যবধানে বাংলাদেশকে এখন ভারত থেকে আলু আমদানি করতে হচ্ছে। এর নেপথ্যে কে বা কারা দায়ী কিংবা কোন কারণ বিদ্যমান, তা খতিয়ে দেখা দরকার। আমরা এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।