জাতীয় কবি নিয়ে দীর্ঘ চক্রান্তের অবসান
প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:৩৫:৫৯ অপরাহ্ন
অবশেষে বাংলাদেশের জাতীয় কবির রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেলেন কাজী নজরুল ইসলাম। ১৯৭২ সালের ২৪ মে বাংলাদেশে আসার তারিখ থেকে তাকে ‘জাতীয় কবি’ ঘোষণা করা হয়। গত ২ জানুয়ারি সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবের সই করা গেজেট প্রজ্ঞাপনে বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত কাজী নজরুল ইসলামের জাতীয় কবির মর্যাদার বিষয়টি জাতীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হলেও গত অর্থ শতাব্দি যাবৎ তাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে জাতীয় কবি হিসেবে ঘোষণা করা হয়নি, এ বিষয়টি অনেকের মনে নানা প্রশ্ন ও রহস্যের সৃষ্টি করেছে। কবি নজরুল ইসলামকে এদেশে এনে নাগরিকত্ব প্রদান করা হলেও এবং দেশবাসীর অকুণ্ঠ সমর্থন, দাবি ও লেখালেখি সত্বেও বিগত সরকারগুলো কেনো তাকে জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেনি, এ ব্যাপারে সচেতন মহলে দীর্ঘদিন যাবৎ ক্ষোভ ও এক ধরণের হতাশা ছিলো। সেই হতাশার মেঘ দূর করেছে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। নজরুলকে নিয়ে বিশেষভাবে তাকে জাতীয় কবি বলতে এদেশের একশ্রেণির ভারতীয় সংস্কৃতি ঘেষা বুদ্ধিজীবির রীতিমতো এলার্জি ছিলো, ছিলো হার্টবার্ন অর্থাৎ হৃদয়ের জ¦ালাপোড়া। এটা বামধারার বুদ্ধিজীবিদের মাঝে বেশি দেখা যায়। অধ্যাপক হুমায়ুন আহমদ তো নজরুলকে শীর্ষস্থানীয় কবি বলতেই নারাজ ছিলেন। তিনি বিটিভির অনুষ্ঠানে প্রকাশ্যে এ বিষয়ে বক্তব্য রেখেছেন। তিনি নজরুলকে নি¤œমানের কবি মনে করতেন। একই রকম ধারণা পোষণ করতেন সৈয়দ শামসুল হকের মতো কবি-সাহিত্যিক। বিষয়টি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। ক্ষমতাসীন সরকারের শিক্ষা ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় তথা শীর্ষ নেতৃত্বও এসব বামধারার কবি সাহিত্যিক শিল্পীদের তোয়াজ করতেন, তাদের পরামর্শ অনুযায়ী চলতেন। একটা বিষয় এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। সেটা হচ্ছে, নজরুলের লেখায় তার অনুসৃত এমনকি এদেশের নব্বইভাগের ও বেশি মানুষের আদর্শ ও ধর্মীয় বিশ^াস ইসলামী উপাদান বিস্তর।
ইসলাম ও মুসলমানদের আবেগ অনুভূতি ও স্বপ্নকে তিনি ধারণ করেছেন তার লেখায়। যদিও হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বিশ^াস আদর্শ ও মিথও বিপুলভাবে বহু গদ্য রচনা বিশেষভাবে প্রবন্ধে এদেশের নির্যাতিত নিপীড়িত ও বঞ্চিত মানুষের কথা বিধৃত হয়েছে সুস্পষ্টভাবে। শোষকও শাসকগোষ্ঠীর মন রক্ষা করে তাঁবেদারি করে জনগণের কথা লেখার মতো দু’মুখো নীতি তিনি কখনোই গ্রহণ করেননি। রবীন্দ্রনাথের মতো বড়ো মাপের কবিও এই দেশ পরিহার করতে পারেননি। একদিকে তিনি ব্রিটিশ প্রভু রাণী ভিক্টোরিয়ার গুণকীর্তন করেছেন, অপরদিকে এদেশের জনগণের কথা বলেছেন।
যা-ই হোক, দেশে এতো জাতীয়তাবাদী দল থাকা সত্বেও এদেশের ১৭-১৮ কোটি মানুষের প্রাণের কবি ভালোবাসার কবি নজরুলকে রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতীয় কবির মর্যাদা ও সম্মান দিতে এতো দীর্ঘকাল অপেক্ষা করতে হলো কোনো, এ প্রশ্ন এখন এদেশের প্রতিটি দেশপ্রেমিক মানুষের। এদেশের শীর্ষস্থানীয় ও বহুল পরিচিত কবিদের মধ্যে কবি নজরুলই এদেশের সকল শ্রেণি এবং সকল আদর্শ ও ধর্ম বিশ্বাসের মানুষের কথা অকপটে প্রকাশ করেছেন তার কাব্য সাহিত্যে। এমন বিষয় দরদের সাথে অসংখ্যবার উপস্থাপিত হয়েছে তার লেখায়। এমন অসাম্প্রদায়িক বড়ো ও প্রশস্ত হৃদয়ের কবি ও লেখক হওয়া সত্বেও শুধু ইসলাম ও মুসলমানদের নিয়ে চমৎকার ও আবেগপূর্ণ লেখার কারণে নাস্তিক টাইপের ঐসব বামধারার বুদ্ধিজীবি ও ইসলাম বিদ্বেষী মহল তাকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করেনি। ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষী মহলকে নজরুলকে জাতীয় কবি হিসেবে পূর্ণ মর্যাদা ও স্বীকৃতি প্রদানের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথকে প্রতিপক্ষ হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করতে দেখা গেছে। একটি বিশেষ দেশ ও সম্প্রদায় কবি রবীন্দ্রনাথকে বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এতোকাল চেষ্টা করেছে এবং এখনো তারা সক্রিয়। সমালোচনা মুখর। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, যেহেতু বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সেই হিসেবে তিনি এদেশের জাতীয় কবি। অথচ এই রবীন্দ্রনাথের বিশাল সাহিত্য ভান্ডার ও লেখায় এদেশের মুসলমান ও ধর্ম ইসলামের তেমন কোন উল্লেখই নেই। বরং মুসলমানদের হেয় ও সমালোচনা করে তিনি ‘শিবাজী উৎসবে’র মতো মুসলিম বিদ্বেষী কবিতা রচনা করেছেন। মুসলমানদের ‘বহিরাগত’ও ‘যবন’ বলে কটুক্তি করেছেন। তৎকালীন পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় বিশ^বিদ্যালয় স্থাপনের ঘোর বিরোধিতা করেছেন। সর্বোপরি পূর্ববঙ্গের বৃহত্তর মুসলিম জনগণের প্রাণের দাবি বঙ্গভঙ্গের দাবির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। বঙ্গভঙ্গ রদের আন্দোলনকে উজ্জীবিত করতে ‘আমার সোনার বাংলা’ নামের গীতি কবিতা রচনা করেছেন, যা এখন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত।
যা-ই হোক, এদেশের জনগণের হৃদয়ের কবি, প্রাণের মানুষ কবি নজরুল ইসলাম শেষ পর্যন্ত এদেশের জাতীয় কবির পূর্ণ মর্যাদা ও সম্মান পেয়েছেন, এটা এদেশের ১৮ কোটি মানুষের সাংস্কৃতিক বিজয়। এজন্য আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছি জাতির পক্ষ থেকে। এই স্বীকৃতি ও ঘোষণার মাধ্যমে বর্তমান ছাত্র-জনতার সমর্থিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দেশ প্রেম ও প্রতিশ্রুতির যে প্রকাশ ঘটেছে এতে কোন সন্দেহ নেই।