ভ্যাটের গজব!
প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:৩০:৩২ অপরাহ্ন
গতকাল মিডিয়ায় ‘পণ্য ও সেবায় নজিরবিহীন ভ্যাট বৃদ্ধি’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে নতি স্বীকার করে দেশের মানুষের দুর্দশার কথা মাথায় না নিয়ে বিভিন্ন পণ্যের ওপর পাঁচ থেকে পনেরো ভাগ করারোপ করা হয়েছে, যা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নতুন করে পণ্যে ভ্যাট বৃদ্ধি ও শুল্কারোপের ফলে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাবে। এমনিতেই মানুষ নিত্যপণ্যের চড়া মূল্যের কারণে কষ্টে আছেন। সরকারের নতুন সিদ্ধান্তে বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি আরেক দফা উস্কে দেবে। তারা বলছেন, আইএমএফ’র শর্ত পূরণে এমন সিদ্ধান্ত নিলেও সরকারের উচিত ছিলো ভ্যাট ও শুল্ক না বাড়িয়ে বরং করের আওতা বাড়ানো।
মোবাইল টক টাইম ও ইন্টারনেট, আমদানি করা ফল, ফলের জুস, পেইন্ট এবং বার্নিশ, চমড়া ও জুতার কাঁচামাল, ডিটারজেন্ট ও পানীয়সহ ৪১টি পণ্য ও পরিষেবার জন্য সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধি করা হয়েছে ৫০ শতাংশেরও বেশি। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যারয়ের অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, এমনিতেই মানুষ শ^াসরুদ্ধকর অবস্থায় আছে। এখন নতুন করে ভ্যাট ও করের হার বৃদ্ধির কারণে পণ্যের দাম আরও বেড়ে যাবে, এতে মানুষের কষ্ট আরো বাড়বে।
সিপিডি’র সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সরকার ১শ’টির মতো পণ্যে শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক, আবগারি শুল্ক বৃদ্ধি করেছে। শুল্ক বাড়ানোর ফলে এর প্রভাব শেষ পর্যন্ত ভোক্তার ওপর গিয়েই পড়বে। এতে মধ্যবিত্ত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠি বেশি আর্থিক চাপে পড়বে। এমনিতেই মানুষ কষ্টে রয়েছে, এরপর কর বৃদ্ধির কারণে মানুষের কষ্ট আরো বাড়বে। তিনি আরো বলেন, আইএমএফ’র ৪র্থ কিস্তির ছাড়ের পাশাপাশি নতুন করে সরকার আরো ঋণ সহায়তা চেয়েছে। এখন এ ঋণ সহায়তা পেতে হলে শর্ত পূরণ করতে হবে। ঋণ পেলে সরকারের আমদানি সক্ষমতা বাড়বে। এতে বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে এবং মূল্যস্ফীতি কমে াসতে পারে। একটি মধ্য মেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও সরকারের প্রত্যক্ষ কর সক্ষমতা বাড়ানোর উপর গুরুত্ব দেয়া উচিত। প্রত্যক্ষ করের মাধ্যমে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি পেলে সাধারণ মানুষের উপর তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।
সচেতন মহলের মতে, হোটেল, রেস্তোরাসহ বিভিন্ন সেবা ও পণ্যের ওপর সরকারের নতুন ভ্যাট ও শুল্কারোপ দেশের বিদ্যমান চড়া মূল্যস্ফীতিকে আরেক দফা উসকে দিতে পারে। বিদায়ী বছরের পুরো সময়ে শহরের চেয়ে গ্রামের মানুষ মূল্যস্ফীতির কারণে বেশি ভুগছে। গ্রামীণ এলাকায় ডিসেম্ব মাসে মূল্যস্ফীতি শহর অঞ্চলের চেয়ে ছিলো। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতে, নভেম্বর মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীীত ছিলো ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। ওই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিলো ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ, যা গত সাড়ে ১৩ বছরের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। তাদের মতে, সরকারের নতুন সিদ্ধান্ত গোটা বাজারেই প্রভাব ফেলবে এবং উসকে দেবে মূল্যস্ফীতিকে।
দেখা যাচ্ছে, রাজস্ব আয় বৃদ্ধির জন্য ভ্যাটের আওতা বাড়ানো ও প্রত্যক্ষ কর বৃদ্ধির পরামর্শে দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্ট সকলেই। এখনো ব্যবসা ও পণ্যের অনেক ক্ষেত্রেই ভ্যাট ও ট্যাক্স আরোপ করা হয়নি যথাযথ ভাবে। বিগত বছরগুলোতে বহু নতুন পণ্য ও সেবা চালু হয়েছে। কিন্তু এগুলো এখনো ভ্যাটের আওতার বাইরে রয়ে গেছে। সর্বোপরি ভ্যাট আদায়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়টি এখন ওপেন সিক্রেট। প্রশ্ন জাগতে পারে, এ পর্যন্ত ক’জন ডাক্তার, আমলা, ইঞ্জিনিয়ার, রাজনৈতিক নেতা ও অন্যান্য পেশাজীবি দেশের সর্বোচ্চ করদাতা নির্বাচিত হয়েছেন। অনেকেই তো শত শত হাজার কোটি টাকার মালিক। প্রতি বছর ঘুরে ফিরে কয়েকজন ব্যবসায়ীকেই ভালো করদাতার পুরস্কার পেতে দেখা যায়। বড়ো বড়ো শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক ও ব্যবসায়ীরা এই তালিকায় দেখা যায় না বললেই চলে। এদের নিকজ থেকে কর আদায় করা হলে দরিদ্র জনগোষ্ঠিকে অধিকতর আর্থিক চাপে ফেলে বিভিন্ন পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট ট্যাক্স বাড়াতে হতো না। আশাকরি, রজস্ব বিভাগ তথা সরকারের শীর্ষ মহল বিষয়টি মনোযোগ সহকারে বিবেচনা করবেন এবং জনবান্ধক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন একেস্ত্রে।